May 1, 2020

রাগ আলাপ : নিবদ্ধ ও অনিবদ্ধ সঙ্গীতের প্রভাব

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

ডঃ জয়ন্ত কুমার মল্লিক

কণ্ঠসঙ্গীত বিশেষ করে ধ্রুপদ ও খেয়ালের আলাপের যথেষ্ট সুযোগ আছে। সুযোগ বললে ভুল হবে। আলাপের একটি রীতি ও নিয়ম আছে। তার কারণ আলাপ শব্দটির একটি সাধারণ অর্থই হল পরিচয়। অর্থাৎ রাগের পরিচয় বা রাগ সম্পর্কে যে জানান দেওয়া সেটির প্রথম কাজ আলাপই করে। এর একটা দিক হল শাস্ত্রীয় দিক আর একটি দিক হল শ্রোতা বা বিশেষজ্ঞ ও সমাজদার শ্রোতার সামনে তুলে ধরা রাগটির সম্পর্কে। আর একটি দিক হল যিনি রাগটি পরিবেশন করছেন সেই শিল্পীর সেই রাগ সম্পর্কে নিজের দৃঢ় আস্থা এবং শ্রোত্রী মন্ডলীকে নিজের সম্পর্কে ও রাগ সম্পর্কে জানানো। কারন শাস্ত্রীয় বা অন্য যেকোন সঙ্গীতের ক্ষেত্রি (বি ‘ষ করে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রে) শ্রোতারা একটা আসা বা বিশ্বাস নিয়ে আসেন যে যিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশন করছেন তার ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শাস্ত্রীয় দিক (তত্ত্ব) এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের (ব্যবহারিক দিক) উভয় দিকের একটি সম্পূর্ণতা আছে যেটি শ্রোতাদের মানসিকতাকে আস্বস্থ করে। ফলে একথা বললেই হয় যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের (রাগ উপস্থাপনের ক্ষেত্রে) আলাপ-আলপ্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক এবং এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটির গুরুত্ব অনুধাবন এবং বাস্তবায়ন ক্ষেত্রে শিল্পীকে যথেষ্টই সজাগ হওয়া দরকার এবং দক্ষতা আনয়নে রাগ সম্বন্ধে জানাশুনা যত বেশী থাকবে, সেই রাগ সম্বন্ধে জ্ঞান যত গভীর হবে ততই সেইরাগকে প্রকাশ করা সম্ভব হয়। এই সম্ভাবনাটির পরিপূর্ণতা আসে তখনই যখন একজন শিল্পী রাগের সঙ্গে দীর্ঘ দিনের পরিচয়, তার সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান, অধ্যাবসায় সহকারে তাকে বিশেষ ভাবে চর্চা এবং উপস্থাপন পক্রিয়া পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান ইত্যাদি।

আলাপের কায়দায় প্রাচীনপন্থীরা ধ্রুপদাঙ্গের আলাপই পছন্দ করে। আলাপে ফিকরা বন্দি কায়দা, মুরকির ব্যবহার, ঠুমরীর চালে, বা চটুলতান প্রভৃতির বাবহার উচিত বলে বিবেচনা করেন না। কিন্তু আজকের দিনে আলাপে এই সব নিময় সঠিক ভাবে মেনে চলা হয় না। অবশ্য ধ্রুপদ গায়কদের মধ্যে অনেকেই এখনো এ নিয়ম মেনে চলে। অধিকাংশ যন্ত্রীরাও এই নিয়মের ব্যাতিক্রম করে থাকে।

গানের ক্ষেত্রে এই কথাটি সত্য। অবশ্য তার একটা কারণ আছে। কণ্ঠ আর যন্ত্রের মধ্যে সুরের রেশ এর মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। এর মূল দিকটি হল দম। কণ্ঠ সঙ্গীত শিল্পীরা যখন গান করেন তখন ‘দম’ তার নিয়ন্ত্রের মধ্যে থাকে এবং দম অনুযায়ী স্বরক্ষেপন বা শব্দ ক্ষেপনের পরে যে রেশ তা বেশি বা কম হতে পারে। কিন্তু যন্ত্রের ক্ষেত্রে এই দম অর্থাৎ যন্ত্রের শ্বাস কম বলেই আলাপে স্বরের দীর্ঘ স্থায়ীত্বের প্রতি বিশেষ ঝোঁক না দিয়ে মাধুর্যটিকে গুরুত্ব দিয়ে আলাপে নানা চটুল অলংকার ব্যবহার করা হয়। সেখানে খেয়াল গায়ক তাদের টিমা গানের সুর-বিস্তার জুড়ে রাগ রূপায়নে চেষ্টা করেন এবং বিভিন্ন অলংকারে রাগটাকে ভরিয়ে তোলেন মধুর ভঙ্গিমায়। এখানে আরও একটি কথা হল খেয়াল গানে আলাপের প্রয়োজন ততটা নয় যতটা ধ্রুপদের আছে।

যেহেতু শিল্প যেকোন বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে সেহেতু এটিকে রোধ করা সম্ভব নয় এবং পরিবর্তনের মধ্যেই নতুনের আগমন ঘটে। তবে যেকোন শিল্পেরই শাস্ত্রীয় দিকটির প্রতি লক্ষ্য রেখে এই সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে যে, পরিবর্তন হোক কিন্তু যেন তাতে কোন যথেচ্ছাচার না ঘটে। কারন আলপের যথেচ্ছাচারিতা বা নিয়ম বহিভূত আলাপ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে শাস্ত্রের বাইরে নিয়ে গিয়ে লঘু মান দিতে পারে।

পদ ও খেয়াল আলাপের যে ভিন্ন প্রকার সেই সম্পর্কে আলোচনায় আলাপের অঙ্গ বিষয়ক দিকটি আলোচনা করা যেতে পারে। আলাপের অঙ্গগুলো হল স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী আভোগ, জোড়, দ্রুত জোড় এবং ঝংকার। স্থায়ীটি হল বিলম্বিত লয়ে আলাপ। যেটি শুরুতেই থাকে। মধ্য সপ্তকের ষড়জ বা কোন একটি রাগের যে প্রকাশ স্বর আছে সেটিকে অবলম্বন করেই সাধারনত শুরু করা হয়। এবং আলাপের প্রথম অংশ স্থায়ী বিভাগ বিলম্বিত রাখা হয়। মুদারার ‘সা’ স্বর থেকে উদারার ‘ম’ এবং ‘প’ পর্যন্ত গিয়ে এবং রাগ অনুযায়ী মুদ্দারার ‘মা’ ‘প’ বা ‘নি’ বা বিশেষ ক্ষেত্রে তারার ‘সা’স্বরটি ছুঁয়ে আবার মুদারার ‘সা স্বরে ফিরে এসে স্থায়ী অংশের সমাপ্তি হয় এবং আলাপের প্রত্যেকটি কলির শেষে, কলিটির সমাপ্তি হয় মুখরা বাজিয়ে।

এবার আসা যাক অন্তরায়। অন্তরার শুরুর স্থানটি হল ‘ম’ বা ‘প’স্বর। তবে রাগ কেন্দ্রিক তারায় ‘রে’ ‘গ’ ‘ম’ এবং ‘প’ প্রভৃতি স্বরে এসে তারার ‘সা বা মুদারার ‘নি’ স্বরের উপর এসে উপস্থাপন এবং সেখান থেকে বিভিন্ন স্বর পরিক্রমা করে মুদারার ‘সা’ স্বরে ফিরে এসে অন্তরায় সমাপ্তি ঘটে মুখরা বাজিয়ে। এর পরের অংশটি সঞ্চারী বা আবেগ। সঞ্চারী অর্থ গমন শীলতা। আর ভোগ এর অর্থ সাঙ্গতিক অর্থে বিস্তার করা। এই দুটি শব্দ এবং তাদের ক্রিয়া আলাপ অঙ্গের অন্তর্ভূক্ত।

সঞ্চারী অংশ থেকেই আলাপ আলপ্তির লয় ক্রমশ দ্রুত হতে থাকে। এর সাথে ব্যবহৃত হয় গমক, নানা অলংকার উদারা ও মুদারার স্বর সংযোগ এবং স্বর বৈচিত্র্য দিয়ে রাগটি প্রকাশিত হয়। আবার প্রদর্শন করা হয় একই সাথে রাগের আবির্ভাব ও তিরোভাব। তিনগ্রামে সংযোগে অলংকার প্রয়োগ দক্ষতায়। এই তিন গ্রামে স্বর বৈচিত্র দেখানো  হয় এবং পরে মুখরা বাজিয়ে সঞ্চারী বা ভোগ শেষ করা হয় মুদার ‘সা’ তে ফিরে এসে।

এর পরের বিষয়টি আভোগ যাকে মুক্তায়ী বলা যায়। এটি সমাপ্তি স্থান বা সমাপ্তির অংশ টীমা আলাপে।এই স্থানে রাগটির যে অলংকৃত রূপ তা তারার সপ্তক থেকে আসতে আসতে এক একটি স্বরে দাড়িয়ে অবরোহী স্বরের সংযোগে মুদ্রার দিকে বিস্তৃত হয়। এর পরের অঙ্গটি জোড়। যেখান থেকে আলাপের লয় দ্রুত হতে থাকে। এখানে দ্রুততর হতে থাকে আলাপের লয় এবং জোড় বাজান হয় স্থায়ী অন্তরা মিলিয়ে। আবার নিয়ন্ত্রন পটুতা নিয়ে স্থায়ীর জোড় ও অন্তরার জোড় আলাদা ভাবে দেখানো  হয়। এটি মধ্য লয়ের সঙ্গে দ্রুত লয়ের সংযোগ ঘটায়। আবার এটি লক্ষণীয় যে তারাগ্রামের স্বরে ব্যবহার খুবই সামান্য মানে মুদারা, উদারার স্বর বিস্তারে আবদ্ধ থাকে। জোরের সঙ্গে মাঝে মাঝে যুক্ত হয় অলংকার। এটিকে ‘মঠ’ জোড় বলা হয়। এটি সাধারনত মুদারা মধ্য থেকে শুরু হয়(তবে উদারা স্বর থেকে অনেক ‘মঠ’ জোড় শুরু করে)।

এর পরই আলাপের অঙ্গ হিসাবে আসে দুত জোড়। এটির আরম্ভ স্থান সাধারনত পঞ্চম এবং বিস্তার চলতে থাকে তার স্বরে। জোড় শেষে দ্রুতলয়ে মুখরা বাজিয়ে জোড় শেষ করা হয় মুদারায় ‘সা’ স্থানে এসে। বলা যেতে পারে, গানের আলাপের সমাপ্তি হয় এখানেই এবং এরপর শুরু হয় যন্ত্রের দ্রুততম কাজগুলি। তবে গায়কদের মধ্যে অনেক যন্ত্র সঙ্গীতের কাজগুলি অনুকরন করেন বিভিন্ন ছন্দে তেলেনার বোলে। (অতি দ্রুততার সাথে আলাপ সমাপ্তির মাধ্যমে।

আলাপের যে ভিন্ন প্রকার আছে তারমধ্যে আলাপ প্রাচীন প্রকার খুবই উল্লেখযোগ্য। এর অন্তর্ভুক্ত হল প্রাচীন স্থান ও স্থাপনা যুক্ত আলাপ। চারটি তুক বর্তমান আলাপে প্রচলিত। প্রাচীনকালের নিয়ম অনুযায়ী স্বস্থান আলাপে চারটি বিশেষ স্থান থেকে (শাস্ত্রীয় নিয়ম ছিল) আলাপের আরম্ভ করা।

এই নিয়ম পালনের ক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় কঠোরতা ছিল। কারন প্রাচীন কালের আলাপ আলপ্তির গুরুত্ব শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে যথেষ্টই মানা হতো। এই চারটি স্থান হল মুখ চাল, দ্ব্যর্থ, অর্ধস্থিত, দ্বিগুন।এইগুলির সংজ্ঞা প্রনয়ন করা হল মুখচাল বা স্থায় স্থানটি হল রাগের বাদীর স্বররূপ , স্বরগুচ্ছ।এই বাদীস্বর থেকেই আলাপ আরম্ভ করার রীতি ছিল (বর্তমানে এটি প্রচলিত আছে) মুখচাল বা স্থায়ী স্থানের বিস্তার সীমা বাদী স্বর থেকে সমবাদী স্বর পর্যন্ত। বাদী স্বরের উপর সমস্ত রাগ নির্ভর করতো। বাদীস্বরকে স্থায়ী স্বর বলা হতো।

দ্ব্যার্ধ স্বরটি হল সংবাদী স্বরের মত। প্রাচীন কালে এই স্বরটি স্থায়ের চতুর্থ স্থানে স্থিত স্বর। আর এর বিস্তার সীমা ছিল যেহেতু দ্বিতীয় ভাগের আলাপ সেহেতু মন্দ্র সপ্তকের বাদী হিসাবে চতুর্থ স্বর থেকে মধ্য সপ্তকের সংবাদী অর্থাৎ বাদীর চতুর্থ স্বর পর্যন্ত অবস্থিত স্বরগুলি হল আলাপের তৃতীয় ভাগ। ফলে এই স্বরগুলি ও ব্যবহৃত হত তৃতীয় ভাগের আলাপের। দ্ব্যর্থ ও দ্বিগুন স্বরে মধ্যস্থিত স্বরগুলি হল অর্ধস্থিত স্বর। উদাহরন স্বরূপ যদি বাদীস্বর ‘সা’ হয় তবে তার অর্ধস্বর ‘প’ থেকে ‘নি’ এর পরে আসা যাক দ্বিগুন স্বরের সংজ্ঞায়। এটি হল বাদীর অষ্টম স্বর। সাধারণত দ্বিগুন স্বর মানে চড়ার স্বর। আর এটি বিস্তৃত করার রীতি ছিল বাদীর অষ্টম স্বর পর্যন্ত। সেহেতু এটি তৃতীয় ভাগের আলাপ।

অনিবদ্ধ রাগ রূপায়নে রাগ-আলাপ, রূপ-আলাপ, সম-আলাপ, থায় আলাপ। এবার আসা যাক আধুনিক আলাপ এর প্রকার ভেদে। ধ্রুপদ ও খেয়াল আধুনিক আলের প্রকার ভেদে আলোচনা করা হলো রংপুরের স্বর্গীয় ওস্তাদ ছম্মণ খী সাহেবের মত অনুযায়ী। এই ঘর বা ঘরাণা অনুযায়ী আলাপ চার প্রকার। রাগ-আলাপ, রূপ-আলাপ, সম-আলাপ, থাই আলাপ। রাগ আলাপটি হল রাগের গ্রহস্বর থেকে উৎসারিত। এখানে গ্রহ অর্থে বাদীস্বর অন্যান্য স্বর গুলি বাদী স্বরের সঙ্গে এমন ভাবে ব্যবহার করা হয় যাতে রাগের আবির্ভাব রূপটি প্রকাশিত হয়। (এটি রাগ আলাপের প্রথম ধাপ) রাগকে আবির্ভাব অবস্থায় রেখে এক একটি তুক এ ভাগ করে আলাপ করা হয়। তিন চার আবৃত্তিতে (স্থায়ী তুক) রাগের স্থায়ী শেষ করে অন্তরা দেখান হয়। তার পর সঞ্চারীতে আসা হয়। তারপর আবেগে আসা হয়। দুই তিন আবৃত্তি শেষ করে। তার পর আলাপের সমাপ্তি ঘটে দুই এক আবৃত্তি আবেগ দেখিয়ে।

রূপ আলাপটি হল এক আবৃত্তি স্থায়ী ও এক আবৃত্তি অন্তরা দুটি দেখিয়ে সঞ্চারী ও আভোগ পর পর এক এক আবৃত্তি দেখিয়ে আলাপের সমাপ্তি ঘটান হয়। যেহেতু এই আলাপে রাগের রূপ প্রদর্শনই মূল ব্যাপার সেই হেতু এই প্রকারের আলাপ রূপ আলাপ বলে পরিচিত। সম আলাপটি হল বিস্তৃত আকারে আলাপ। বিস্তারিত ভাবে রাগ আলাপে সমস্ত কাজ এবং তার থেকে আরো কয়েক আবৃত্তি বেশি করে দেখানো  এবং তার পর নানা অলংকার ও জোড় দেখানো। অর্থাৎ চার ত্বকের কাজ যথা স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী, আভোগ। বিস্তৃত ভাবে দেখানো র পর আলাপের সমাপ্তি হয় জোড়ে এসে।

থায় আলাপ আধুনিক আলাপ এর প্রকার ভেদের সর্বশেষ আলাপ, যা প্রাচীন স্বস্থান এবং  স্থান যুক্ত রাগ আলাপ সমান। এরপর আসা যাক আলাপের প্রকার সূচক আলোচনা যেখানে কয়েদ আলাপ অভিচার আলাপ বন্ধন আলাপ এবং বিস্তার আলাপ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তবে বিশেষত এই আলাপ গুলি সেনী ঘরানার অন্তর্ভূক্ত। সুতরাং অধ্যায় প্রাসঙ্গিকতায় এই সম্পর্কিত আলোচনা সপ্তম অধ্যায়ে করা হল।

প্রাচীন আলাপে প্রকারভেদে সঙ্গীত রত্নাকর এর মত অনুযায়ী প্রাচীন আলাপে নিয়ম আলোচনা করা হল। এই মতে দুটি প্রকার আলাপ হল রাগ আলাপ ও রূপক আলাপ। শাস্ত্র অভিহিত রাগের দশটি নিয়মকে মেনে রাগকে বিস্তার করার যে পক্রিয়া বা পথ, প্রাচীন কালে এই ধরনের আলাপই রাগ আলাপ বলে অভিহিত হত। এই আলাপে উপকরন ছিল স্ফুরিত, কম্পিত গমক। প্রভৃতি সাধারনত এই ধরনের আলাপ রাগের স্কুল আলাপ।

এরপর রূপক আলাপ রাগের রূপকে প্রকাশ করার জন্য ছােট ছােট ভাগে ভাগ করে আলাপের মাধ্যমে দেখানই হল রূপক আলাপ। আলাপ আলপ্তির আর একটি প্রকার আমরা পাই একাদশ শতাব্দীতে সোমেশ্বর লিখিত মানসোল্লাস গ্রন্থে এবং সঙ্গীত রত্নাকর এই সম্পর্কে বিবরন ১৩শ শতাব্দী থেকে পাওয়া যায়। এই প্রকার আলপ্তি আলাপে রাগকে বিষদভাবে ফুটিয়ে তোলা হতো এবং রাগের বৈচিত্র্য তৈরি করা হতো বিভিন্ন ভাবে বিস্তার করে। সেখানে রাগ আলাপ ও রূপক আলাপের সমস্ত নিয়মই পালন করা হয়।

নগমাতে আসরফীর লেখক মহম্মদ রজ্জা তাঁর গ্রন্থে চার প্রকার তানের অর্থাৎ বিস্তারের কথা লিখেছেন। প্রথমটি হল অস্থায়ী বরণ। যেখানে একটি চক্র তৈরি করা হয়। ‘সা থেকে আরম্ভ করে খাদে গিয়ে মাঝের মধ্যম-পঞ্চম পর্যন্ত নিয়ে স্থায়ীর মত। দ্বিতীয়টি হল সঞ্চায়িত বরণ এটি তারার ‘সা পর্যন্ত যায়। অন্তরার মত।

তৃতীয়টি হল আভোগ বরণ এটির আরম্ভ করার নিয়ম মাঝের ম, প, ধ প্রভৃতি স্বর থেকে। (সীমাবদ্ধ থাকে খাদের মাঝামাঝি পর্যন্ত)। চতুর্থটি হল ঝুলতি বরণ। যেকোন স্বর থেকে এটি হতে পারে। প্রাচীন আলাপের ক্ষেত্রে অর্থাৎ এটির আরম্ভ স্থান রাগের যেকোন স্বর থেকে, যা প্রাচীন আলাপের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে এবং নগমাতে লেখক হিন্দীতে প্রাচীন স্বস্থান আলাপের ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছে। ধ্রুপদ ও খেয়ালের নিবন্ধ ও অনিবদ্ধ গানের প্রভাব কণ্ঠ সঙ্গীতে বিশেষ করে ধ্রুপদ ও খেয়ালে নিবদ্ধ-অনিবদ্ধ গানের যে প্রভাব সে সম্পর্কে আলোচনায় আসার পূর্বে নিবদ্ধ গান সম্পর্কে আরো একটু ধারনা নেওয়ার প্রয়োজন। তার কারন ধ্রুপদ এবং খেয়াল উভয়ের কিছু অংশ আছে যেখানে নিবদ্ধ এবং অনিবদ্ধ দুটিরই উপস্থিতি এবং উল্লেখ যোগ্যতা রয়েছে।

এবং তারই সূত্র ধরে এই দুটিরই প্রভাব কণ্ঠ সঙ্গীতের ক্ষেত্রে কিরকম এবং কতটা সেটিই আলোচ্য। নিবদ্ধ গান সম্পর্কে পূর্বে আমরা যে আলোচনা করেছি সেটির সূত্র ধরে বলা যায় যে বিভিন্ন শিল্পীর বা প্রকারের মাত্রাযুক্ত ছন্দবদ্ধ আলাপের গানই নিবদ্ধ গান বা নিবদ্ধ গীতিও বলা হয়। আর এই তালবদ্ধ গীতের পরিচায়ক হিসাবে আমরা পাই বস্তু, রূপক, প্রবন্ধ, ইত্যাদি প্রবন্ধের নানা বিভাগ। মূলত পাঁচটি তুক নিয়ে প্রবন্ধ গীত। আর এই তুকগুলোই ধাতু। এই ধাতু গুলো হলো উদগ্রাহ, মেলাপক, ধ্রুব, আভোগ, ও অন্তর যেটি রাগের প্রথম অংশ সেটি উদগ্রহ আর উদগ্রহই চিহ্নিত করে দেয় In Reference to Raga what is what. আর ধ্রুব হল দ্বিতীয় চরণ যেখানে পদকে দুটি চরণে ভাগ করে। দ্বিতীয় অংশটিকে বা দ্বিতীয় চরণটি ধ্রুব বলে পরিচিত। মেলাপকটি হল উদগ্রাহ ও ধ্রুব উভয়েরই মিলিত রূপ। আর অন্তরটি হল স্থায়ের পরের অংশটি ল(সালগ সুড় প্রবন্ধে তার ব্যবহার ছিল)। আভোগটি হল গানের শেষ চরণ বা অংশ এই চিত্রগুলি নিবদ্ধ গানের পরিচিতি। আর অনিবদ্ধ গান সম্পর্কে আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি। এরপর কথা হল যে ধ্রুপদ ও খেয়াল গানের নিবদ্ধ অনিবদ্ধ গানের প্রভাব কি রকম। প্রথমে আসা যাক ধ্রুপদে। ধীর, গম্ভীর, ধ্যান স্তিমিত, অন্তর মুখীনতা, শান্ত গম্ভীর সংযত এক শিব রূপ। একে ধ্রুবক ও বলা হয়। ধ্রুব প্রবন্ধ থেকেই ধুপ এসেছে এবং সাল সূরা প্রবন্ধ এর আদিরূপ। এবং ধ্রুব প্রবন্ধ নাম ভেদে ধুবক, ধ্রুবপদ বা ধ্রুপদ নামটি আসে। ১৩ শ খ্রীষ্টাব্দে বর্তমান ধ্রুবদের কোন পরিচিতি ছিল না। তখন ছিল নিবদ্ধ গীত যার মধ্যে দিয়ে প্রবন্ধ, রূপক প্রভৃতির নাম পাওয়া যায়। আর ১৫ শ খ্রীষ্টাব্দের শেষ ভাগ থেকে ধ্রুপদ একটি নির্দিষ্ট রূপ পরিগ্রহণ করে যেখানে তুক ও তালের একটা পরিবর্তন আসে।

তবে স্পষ্ট করে কথা বলা যায় যে গোয়ালিয়র রাজা মানসিংহ তোমার-ই ধ্রুপদের শ্রষ্ঠা তিনি এই গানকে ধ্রুপদকে সাংগেতিক রূপ দিয়েছিলেন এবং চলিত শব্দ এবং সরল বাক্যরচনায় তিনি জনপ্রিয় করেছিল। এর স্বপক্ষে মােঘল ভারতের সঙ্গীত চিন্তায় রাজ্যের মিত্র যেটা বলেছেন তা হল “রাগ দর্পণ কার প্রথমে রাজা মানকে ধ্রুপদ রচয়িতা বলেছেন। ধ্রুপদ উদগ্রাহ মেলাপক, ধূয়া ও আভোগ এই চারটি কলিতে নিবন্ধ হতে। দুই ধরনের ধ্রুপদ ধ্রুপদের পদ্ধতির প্রচলন আছে। প্রথম শ্রেণীর ধ্রুপদ রাগ ও গীত মার্গপদ্ধতিকে অবলম্বন করে রচিত। আর দ্বিতীয় শ্রেণীটিতে রাগের প্রভাব অল্প থাকলেও বাক্য এবং শব্দের যথেষ্ঠ উপস্থিতি আছে। কিন্তু দ্বিতীয় পদ্ধতিটি আঞ্চলিক ভাষায় রচিত এবং শিল্পীরা গানের সময় আঞ্চলিক ভাষা ও সুরের প্রয়োগ করে থাকে। এছাড়া দ্বিতীয় পর্যায়ের ধ্রুপদ গানের যে গায়কী বৈশিষ্ট্য বা গায়ন বৈশিষ্ট্য সেটি গায়ক নিজেই করে থাকেন এবং এর সংগঠনটি দেশী মার্গ উভয়ের মিশ্রনে প্রস্তুত। দেশী ভাষায় অনুষ্ঠিত ধ্রুপদ সময় ও স্থান অনুসারে সৎউর্দু ভাষায় গাওয়া হয়।

দেশীয় ভাষায় অনুষ্ঠিত এই ধ্রুপদ গোয়ালীয়র থেকে আগ্রা পর্যন্ত প্রসারিত এবং উত্তরে মথুরা পর্যন্ত এর সীমা। পূর্বে অটোয়া, দক্ষিণে উচু এবং পশ্চিমে ভূমি ও বয়ান পর্যন্ত এর সীমা নির্দিষ্ট। ফকিরুল্লা তার ‘রাগ দর্পন’ গ্রন্থে তানসেন কে গুরুত্ব দিয়েছেন ধ্রুপদের জন্য কিন্তু এটাও ঠিক যে তানসেনের প্রভাব রাজা ঘন বসু প্রভৃতি ধ্রুপদীয়াদের রচিত গান ও তাদের ঘরনা গত যে রীতি পদ্ধতি সেটি লোপ পেতেই থাকে। কিন্তু তানসেনের ধ্রুপদে একটি বৈশিষ্ট্য ছিল সেটি হল গান শুরুর পূর্বে আলাপের রীতি অনুযায়ী গান তিন চার তুকের হতো এবং গানের স্থায়ী ও অন্তরায় গমকের বিস্তার থাকতো। যাতে গমকী বিস্তার বলা হয়। কিন্তু তানসেনের আগে প্রাচীন প্রচলিত পদ্ধতির মত ধ্রুপদে দুগুন, তিনগুন দেখানো র রীতি ছিল। তবে চপল লয়কারীর কাজ কমই ব্যবহার করা হতো। আর বানী ও ভাবের অনুকুলে তালের ব্যবহার ছিল, আর সীমাবদ্ধতা ছিল অলংকার ও গমক এর ব্যবহারে।

ধ্রুপদের বানী সম্পর্কীয় বিষয় ও বর্ণনা থাকতো মূলত রাজাদের স্তুতি বা রাজাসম গুনী ব্যক্তির প্রশংসা প্রভৃতির বর্ণনা, রাগের বর্ণনা, যুদ্ধ বিষয়, এছাড়া প্ৰেম বৈচিত্র্যতা। ভাষা ছিল হিন্দী, শুদ্ধ ব্রজ ভাষা তাল হিসাবে ব্যবহৃত হত চৌতাল তিনতাল, আড়া চৌতাল, ব্ৰক্ষতাল, সুলতাল ইত্যাদি। তবে তেওয়া ও ঝাপতালের ব্যবহার ও ছিল। যদিও বর্তমান পদে তাল সেনীর পদ্ধতি প্রচলিত তবে তাদের কায়দায় ধামারের বাট বাটওয়ারাও প্রচলিত রয়েছে। বিভাগ সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় প্রাচীন ধ্রুপদে ছটি প্রকার ধ্রুপদ ছিল সেগুলি হল গীত, সংগীত, ছন্দ, যুগল বন্দ, ধারু, এবং গীতহার। এই দুটি প্রকার থাকলেও প্রথম দুটি ব্যবহারের দিক থেকে লুপ্ত। কিন্তু পরের চারটি পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে বর্তমানে চালু আছে।

This is a shot of burning incense, with a bit of a lens flare from the flash caught in the image.

ধ্রুপদের বাণী সাধারনভাবে চার প্রকার , যথা – গওহার, নওহার, ডাগুর এবং খান্ডার। আর এই বানীগুলির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঘরানার নাম এবং যিনি প্রচলন করেছে তার নাম এবং এদের জন্ম বিষয়ক তত্ত্ব। বাণী শব্দটিকে বিভিন্ন সঙ্গীতকার বা সঙ্গীত গবেষকরা বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করেছেন।

সঙ্গীত প্রাসঙ্গীকতায় কেউ কেউ এটিকে অঞ্চলের সাথে যুক্ত করেছেন যেমন গোয়ালীয়রের ভাষায় রচিত হলে সেটি গোয়ালীয়র বানী। আবার অনেক স্টাইল বা ঢং কে বাণী শব্দের সাথে জুড়ে দিয়েছেন যেমন গোয়ালিয়র গান গাইবার পদ্ধতি সেটিকে গোয়ালিয়র বাণী বলা হচ্ছে। আবার কোন দেশের গানের বিস্তার বৈশিষ্ট্যকে বাণী বলা হচ্ছে যেমন খান্ডার বাণী। আবার মুসলীম যুগ যে চার রকমের বানী যা তানসেনের কাল থেকেই আসছে যা আমরা পাই ‘মাদনূল মৌসিকী’ গ্রন্থ থেকে। তবে এই চারটি বাণীর শ্রষ্ঠা যে চার জন তানসেন, নৌবাৎ খাঁ, বৃজচন্দ ও শ্রীচন্দ এই চারজনই নাকি শােনা যায় এই চার বাণীর শ্রষ্ঠা। কিন্তু তানসেনের একটি গানের একটি লাইন প্রমান করে যে এই ধারনাটি ভুল সে গানটির শব্দগুলি হল বাণী চারোকে বেওহার শুন লীজে হো গুণীজন কিন্তু আনুমানিক সত্যটি হল এই যে – গৌরহারবানী গোয়ালিয়র থেকে এসেছে। খান্ডারবাণী রাজপুতানা থেকে এসেছে। আর পাঞ্জাব থেকে এসেছে ডাজুর ও নওহাবাণী। আর একটি Authenticity হল শুদ্ধা, ভিন্ন বেসরা, গৌরী প্রভৃতির সঙ্গে বাণীগুলির একটা সম্পর্ক আছে। আর রাগের প্রকৃতি ও চলন বিশ্লেষন করলে আমরা দেখি রাগ দরবারী, কল্যান গৌরহার বাণীর সাথে সম্পর্কযুক্ত বা এই রাগগুলি গৌহারেই প্রসস্ত। আর খান্ডারের চলন সারং রাগ বা খট রাগ এর সাথে চলনশীল। আর ডাগুর বাণী ভূপালী ঘারবাতে প্রশস্ত আবার নৌহারবাণী শঙ্করা, কামো প্রভৃতিতে প্রসস্ত (রাগের সাথে বাণীর সম্পর্ক বা সম্পর্কহীনতা এই দুটোরই যৌক্তিক দিক কতটা আছে তা বলা মুশকিল। তবে একথা বলা যেতে পারে যে একটা যৌক্তিক দিক আছে তাহল, প্রতিটি শব্দের অর্থ আছে। উদ্দেশ্য ও ভাবকে বহন করে কতকগুলি শব্দ পর পর সাজিয়ে বাক্য তৈরি করা হয়। ঠিক তেমনি কোন একটি রাগ যখন ঠাট থেকে গঠন করা হয় তখন রাগের যে চরিত্র আছে অর্থাৎ রাগটির স্বর মাধ্যমের মধ্য দিয়ে সুর, শ্ৰতি এবং অন্যান্য উপকরনের মধ্য দিয়ে একটা আবহ তৈরি করে যা মানুষের মনে তথা পরিবেশের উপর প্রভাব বিস্তার করে। আর এই প্রভাব বা রাগরূপ থেকে রাগের নাম নির্ধারিত হয়। সুতরাং দেখা যায় যে, কোন রাগের যে চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য সেই অনুযায়ী শব্দ সাজিয়ে বন্দিশ তৈরি করা হয়, যা বাণী। আর এই বাণীই রাগ রূপকে প্রকাশ করতে সাহায্য করে।

উদাহরন স্বরূপ বলতে পারি যে, রাগে কোমল স্বর ব্যবহৃত হয় বা যে রাগে শুদ্ধ স্বর ও তীব্র স্বরের ব্যবহার বেশি থাকে সেখানে বাণী ও সেই রকমই ব্যবহার করা হয় বা করা উচিত সেটির সম্পর্কে যুক্তি দেওয়া হয়েছে তানসেনের যুগের ধ্রুপদ রচনা। এবার বাণীগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হল যেমন গৌহরবাণী প্রাচীন ভিন্না জাতীয় গীতি

পদ্ধতির অনুসরণ এবং তানসেন গৌড়ীয় ব্রাক্ষণ থাকার কারণে তার প্রবর্তিত বাণী গওহর বাণী হয়েছে। আর এটি গোয়ালিয়র থেকে উৎপন্ন আর গীতের প্রকৃতি হল ধীর ও শান্ত। তাই দরবারী ও কল্যান  জাতীয় রাগের ভাব থেকে উৎপন্ন। নওহর বাণীটি প্রবর্তিত হয়েছে নওহর গ্রাম নিবাসী শ্রীচন্দ থেকে। এর অর্থ নবরসের একত্র মিলন। এর আর একটি অর্থ হল সিংহ যা হিন্দী নাহর থেকে এসেছে। অর্থাৎ সিংহের মত দ্রুত লম্ফনে। আর অনেকে এটির প্রবর্তক সূজন খাকে বলেছেন। নওহর বাণীর রাগ ও রূপ মাধ্যম হল। কামো, শঙ্করা প্রভৃতি রাগ। এই বাণীটি প্রাচীন বেসরা জাতীয় পদ্ধতি থেকে প্রাপ্ত। ডাগুর বাণীটি অনুদৃত হয়েছে প্রাচীন শুদ্ধ জাতীয় পদ্ধতি অনুকরণ। এর প্রবর্তক হলেন ডাগুর গ্রামের বীজচন্দ্র। আর এই বাণীটি পাঞ্জাব প্রান্তের ডাগুর গ্রাম থেকে উৎপন্ন হয়েছে। আর এর প্রভাবিত রাগ গুলি হল মারয়া, ভূপালী, প্রভৃতি। খাডার বাণীটি প্রাচীন গৌড়ি জাতীয় পদ্ধতি থেকে অনুদৃত, উৎস স্থান খান্ডার গ্রাম। প্রভাবিত রাগগুলি হল সারং খট প্রভৃতি। (এখানে একটি কথা বলা আবশ্যক তাহল বাণী রাগ কে প্রভাবিত করেছে না রাগ বাণীকে প্রভাবিত করচ্ছে সেটি বলা মুসকিল)।

ধ্রুপদের বেশ কয়েকটি ঘরানা আছে যেমন গোয়ালিয়র সেণী, বেতিয়া, অত্রোলী, তিলমান্ডি, ডাগর, বেনারস, বিষ্ণুপুর ইত্যাদি। এখন প্রশ্ন হল যে এই ধ্রুপদে নিবদ্ধ অনিবদ্ধ গানের প্রভাবটি কি? কিরকম এবং কতটা এবং উদয়পুর সেই প্রভাবে ধ্রুপদ গানের পরিবর্তিত রূপ (FORM AND CONTENT) প্রথমে আসা যাক নিবদ্ধ। নিবদ্ধ গানে কতকগুলি উপকরন থাকে। সেই উপকরন গুলির দ্বারা নিবদ্ধ গান গঠিত। আর এই গঠিত অংশগুলি নিয়েই নিবদ্ধ গান প্রভাবিত করে ধ্রুপদ এবং খেয়ালকে।

যে কারনেই বিভিন্ন শৈলীর বা প্রকারের মাত্রা যুক্ত ছন্দবদ্ধ তাল লয়ের গানকেই নিবদ্ধ গীত বলা হয়েছে। প্রবন্ধ বস্তু, রূপক এবং সানগ সূড় এগুলির প্রাচীন কালের তালবদ্ধ গীত এবং এগুলি প্রবন্ধের নানা বিভাগ। এই প্রবন্ধের যে পাঁচটি তুক আছে সেগুলি আবার ধাতু বলে পরিচিত। উদগ্রাহ, ধুব, মেলাপক, অন্তরা ও আবেগ এই পাঁচটি ধাতু।

রাগের যে প্রথম অংশ সেটিকেই প্রাচীন কালের উদগ্রাহ বলে চিহ্নিত করা হয় এবং উদগ্রাহ থেকেই সমগ্র রাগের পরিচিতি পাওয়া যায়। নিবদ্ধ গানের ক্ষেত্রে উদগ্রহের পরের অংশ ধ্রুব। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ তার কারন একটি অর্থবাচক অর্থাৎ অর্থকে বহন করে। গানের যে দ্বিতীয় চরন সেটি ধ্রুব বলে পরিচিত। অবশ্য এখানে চরন অর্থে পদকেই নির্দেশ করা হয়েছে। আরো নিবন্ধ গানের এই দুটি উপকরণ অর্থাৎ পাঁচটি ধাতু প্রথম দুটি উদগ্রাহ এবং ধুবকে মেলানো র বা মিলিত করার ভূমিকা মেলাপাক এর। এটি রাগের মন্দ্র অংশ থেকে মধ্য সপ্তকের বাদীস্বর পর্যন্ত আসে এবং সমাপ্তি হয় বাদী স্বরে। অন্তরা ধাতুটি উদগ্রাহী এবং ধুক-র পরে মেলাপকের পরে এর স্থান। প্রাচীন কালে সালগড় প্রবন্ধে এটিকে ব্যবহার করা হতো। এর পরের ধাতুটি আভোগ এটি গানের শেষচরণ বা পদ। প্রবন্ধ গানকে ধরে পরবর্তীকালে যে বাংলা গান ও এসেছে সেখানে আবেগের ভূমিকা আছে। এই ভূমিকাটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটি প্রাচীন কালের নিবদ্ধ গানের মত নয়। এর চরণ বা পদগুলি হল – (বর্তমানের) স্থায়ী, অন্তরা, (প্রথম) সঞ্চারী, অন্তরা (দ্বিতীয়) এবং আভোগ। (বিশেষ করে বাংলা কাব্য সঙ্গীতে আভোগের ব্যবহার বহুল প্রচলিত)। সাধারনভাবে ধ্রুপদ নিবদ্ধ গান বলেই পরিচিত। কেননা ধ্রুপদ গান যে ক্রম আছে তাতে আমরা দেখি প্রথম আলাপ, দ্বিতীয় বন্দিশ এর স্থায়ী অংশ, তৃতীয় বন্দিশ এর অন্তরা, চতুর্থ লয়কারী

শেষ তিহাই যা তেহাই দিয়ে গানের সমাপ্তি। ধ্রুপদের গায়ন কালে বিস্তার ও উপেজ এর ব্যবহার করা হয়। সমগ্র ধ্রুপদ গানটি নিবদ্ধ ও অনিবদ্ধ রূপে হলেও নিবন্ধের অংশটি বেশি। আর এই নিবদ্ধ অংশটি ধপদ গানের চমৎকারিত্ব বা আকর্ষনের একটি দিক। কারন সঙ্গীতের যে মূল চারটি উপাদান কথা, সুর, তাল ও ছন্দ। এই চারটি সঙ্গীতকে বেঁধে রাখে আর এই চারটি উপকরনের সঠিক স্থাপনা ব্যবহার ও প্রয়োগ সেই গানের সার্থকতা দেয়। নিবদ্ধ গানের যে প্রবন্ধরূপ অর্থাৎ প্রকৃষ্ট রূপে বদ্ধ কাব্য, সুর এবং ছন্দের বা তালের সেটি ধ্রুপদ গান তথা গানের একটি দিক। নিবদ্ধ অংশে চিত্তাকর্ষনের যে মাধ্যম তাতে পাখওয়াজ এর একটা বড় ভূমিকা আছে। পাখওয়াজের যে বোল বাণী (রাগ রূপ এবং  বান্দিশ অনুযায়ী নির্ধারিত তাল গুলি প্রয়োগে বিভিন্নতা থাকে)। যেমন কোন বন্দিশে চৌতাল কোথাও বা ঝাপতাল কোথাও বা সুলতান কোথাও বা ধামার ব্যবহৃত হয়। সেখানে তালের সাথে সাথে ছন্দেরও প্রকারভেদ থাকে। গবেষণালব্ধ চিন্তাভাবনা থেকে বলা যেতে পারে যে ধ্রুপদ বা খেয়াল উভয় ক্ষেত্রেই ‘রাগ, বান্দিশ, তাল’ এবং ছন্দ প্রত্যেকে প্রত্যেকের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত। তার কারন সেখানে রাগের হালকা রূপ বা গম্ভীর রূপ বা চটুল রূপ ও খান্দানীরূপ এবং তার বিষয়ের সম অর্থের বিভিন্নতা। সেই অনুযায়ী বাশি তার শব্দচয়ন তার অর্থ এবং তার চলন, গতি, ঝোক যেমনি নির্বাচন করা হয়। ঠিক তেমনি সেই অনুযায়ী তাল ও ছন্দের দিকটিও আসে। সেখানেও তালের গতি, তার লয় তার চলন তার বোল বানী ঝোক সবকিছুই নির্বাচন করা হয় ধ্রুপদ বা খেয়াল গানের রাগ রূপের নিরিখে অর্থাৎ কেউ এখানে কারোর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। রাগ যেমন বান্দিশ এর মধ্যে নিজেকে প্রকাশিত করে তেমনি বান্দিশও নিজের মধ্যে রাগ রূপকে প্রকাশিত করে। আর এদের মধ্যে গতি, চলন, ছন্দ, লয়, ভাব, ও প্রাণ এর মাধ্যম হল কথা, সুর, তাল ও ছন্দ। আর যে মাধ্যম দ্বারা প্রকাশিত হয় সেটি হল ভারতীয় সঙ্গীতের একটি শাস্ত্রীয় রূপ (ধ্রুপদ বা খেয়াল)। আর প্রকাশ মাধ্যম হল কণ্ঠ বা যন্ত্র। আর সহায়ক অন্তর ছন্দ বহিঃছন্দের মাধ্যম হয় বিভিন্ন অনিবদ্ধ বাদ্য, ততবাদ্য, ঘনবাদ্য এবং সুষীর বাদ্য।

রাগকে কেন্দ্র করে যে পদ বা চরণ এবং সুর, তাল ও ছন্দ আসে তা সহজেই অনুমেয়। তা বাংলা কাব্য সঙ্গীত হোক বা আধুনিক গান হোক বা ঠুমরী, টপ্পা, গজল হোক, গীত বা ভজন হোক বা লোকসুর আশ্রিত গান। সবক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পাই যে একটি গান তৈরিতে যেমন পরিবেশ বা পেক্ষিতের ভূমিকা থাকে তেমনি এই পরিবেশ বা পেক্ষিত কে কেন্দ্র করেই একটি সার্থক গান তৈরি হয়।

ফলে এটা বলা যেতেই পারে যে ধ্রুপদ গানের ক্ষেত্রেও রাগ রূপ বন্দিশ তাল ছন্দ এবং বাদ্য মাধ্যমে।  যথেষ্ট গুরুত্ব ও ভূমিকা রয়েছে। নিবদ্ধ-অনিবদ্ধরূপ এদুটির ভূমিকা বা প্রভাব ধ্রুপদ ও খেয়ালে কতটা রয়েছে বা কিরকম সেটি নিরুপন এই উপলব্ধি থেকেই হতে পারে যে যেকোন বিষয় বস্তু বা ভাবের বা রূপের মূল দুটি দিক আছে। সেটিকে আমরা এই ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি পজেটিভ এবং নেগেটিভ, ভালো এবং মন্দ, পক্ষ এবং বিপক্ষ, সমার্থক-বিপরীতার্থক ইত্যাদি। যেমন – সময়, প্রহর, ক্ষণ, ফেলা, ক্ষেত্রে দিন ও রাত্রির যে ভূমিকা তা ভিন্ন ভিন্ন হলেও আমাদের কাছে এই দুটির গুরুত্ব আছে। তেমনি গুরুত্ব আছে ভালো এবং মন্দ উভয়েরই। গুরুত্ব আছে শুধু সৃষ্টির নয়, ধৃংসের। গুরুত্ব আছে সমার্থক ও বিপরীতার্থের গুরুত্ব আছে বিভিন্ন ইন্দ্রিয় উপলব্ধির (তা ভালো হোক বা মন্দ হোক)। ঠিক সেই ভাবেই গুরুত্ব আছে নিরবতার ও স্বরবতার, ব্যক্ত-অব্যক্তর ঠিক এই ভাবেই ধ্রুপদ ও খেয়ালের নিবদ্ধ ও অনিবদ্ধ গানের দিকটি বিবেচ্য। (এখানে একটি কথা বা একটি বিবেচনা চেতনাশ্রিত হওয়া উচিৎ যে তা হল পজেটিভ এবং নেগেটিভ বা ভাল-মন্দ বা ইন্দ্রিয়সুখও উপলব্ধি বা দুঃখ-সুখ, সবকিছুই বিবেচনা করা উচিৎ চাহিদা ও প্রয়োজনের নিরিখে। ঠিক তেমন ভাবেই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ধ্রুপদ ও খেয়ালে নিবদ্ধ ও অনিবদ্ধ উভয়েরই স্থাপনা, গুরুত্ব ও জায়গা থাকলেও ভাগ বা অংশ বা শতাংশের নিরিখে বেশি কমের ব্যাপারটি আছে। প্রয়োগ, স্থাপনা বা ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই যে অংশের নির্বাচন সেটিই এই দুটি দিকে গুরুত্ব রয়েছে। যেমন গতিকে বোঝা যায় তার গতিহীনতা থেকে, কর্মকে বোঝা যায় তার বিশ্রাম থেকে, অন্ধকার বা রাত্রিকে বোঝা যায় দিন ও আলোর ভূমিকা থেকে, তেমনি প্রতিটি স্বাদকে উপলব্ধি করা যায় তাদের বিভিন্নতা থেকে।

সুতরাং ধ্রুপদ ও খেয়ালের নিবন্ধ ও অনিবদ্ধ যে প্রভাব সেটি একই অর্থে বিচাৰ্য্য ধ্রুপদ গানের সূচনায় যে অনিবদ্ধ রূপ আলাপ-আলপ্তি সেটি একদিকে যেমন নিজের ক্রিয়া রূপ ও কর্মরূপ দিয়ে নিজেকে প্রকাশিত করে ধ্রুপদকে তার স্বরূপে প্রকাশিত করচ্ছে তেমনি নিবদ্ধ অংশকেও প্রজ্জল ও জাগরিত করার সহায়ক ভূমিকা নিচ্ছে। কারণ যে কোন বিষয়ের রূপ থেকে রূপান্তর, বিষয় থেকে বিষয়ের বৈচিত্র্যতা এবং বৈচিত্র্যতা থেকে আবার বিষয়ে ফিরে আসা, বা রূপ থেকে অরূপে গমন বা সীমা থেকে অসীমে যাওয়া আবার স্বস্থানে ফিরে আসা এটিই একটি বিষয়কে বিষয়কৃত করে। যেখানে এবং বিষয়ীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ধ্রুপদ গানের ক্ষেত্রেও অনিবদ্ধ এবং নিবদ্ধ পরস্পর বা একে অপরের জন্য। অর্থাৎ ধ্রুপদে যে বাণী গুলো (যেগুলো নিরর্থক বলা হয়)। নাম, তোম, তেনে, রিতে, তেরতা ইত্যাদি শব্দগুলি দ্বারা যখন রাগ রূপক প্রকাশ করা হয় সেখানে থাকে না বাদ্যের ব্যবহার (পাখওয়াজ বা মৃদঙ্গম)। কিন্তু অন্তর ছন্দ এবং ঝোক সেখানে প্রবাহমান থাকে। এই অংশের ক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হওয়ার পরই যখন বান্দিশ এ গৎ এ আসা হয় তখনই নিবন্ধের ক্রিয়াটি শুরু হয়। এবং পাখওয়াজের বোল বাণী (নির্ধারিত তাল) গানের সাথে বাজতে থাকে এবং ধ্রুপদের ব্যাকরণ রীতি, নীতি, পদ্ধতি, গায়কী,স্টাইল বা কৌশল অনুযায়ী স্থায়ী অংশের প্রস্তাবনা। স্থায়ী অংশটি নিবদ্ধ তালে গীত হয়ে নিবদ্ধ রাগটির বিস্তার করা হয়। এই বিস্তার অংশে রাগ রূপ অনুযায়ী বিভিন্ন ছন্দে বোল বিস্তারের মধ্যে দিয়ে অন্তরার অংশে পৌঁছায়। এর পর অন্তরা তুটি গীত হয়। অন্তরা তুটি গীত হয়ে স্থায়ী অংশে প্রর্তাবর্তন করা হয়। স্থায়ী এবং অন্তরা তুকটি গায়ন কালে উপেজ এবং তেহাই এর ব্যবহার করা হয়। অন্তরা তুকটি গীত হয়ে স্থায়ী অংশে ফিরে এলে বাট তথা লয়কারী প্রদর্শন করা হয়। এই লয়কারী প্রথম দুই গুন তার পর তিন গুণ গুন, এবং ভগ্নাংশ যুক্ত লয়কারী আড়, কুয়াড়, এবং বিয়াড় প্রদর্শন করা হয়।

গায়ণরীতির পরিসমাপ্তিতে পাখােয়াজের বোলবানানা ক্রিয়া প্রদর্শন এবং সমগ্র গানটি তেহাই দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটান হয়। ধ্রুপদের এই নিবদ্ধ রূপটি ধ্রুপদের উৎকর্ষতা নির্মাণ করে। এই উৎকর্ষতা সাথে জরিয়ে আছে কতক গুলি কারণ (১) নিবদ্ধ গান প্রকৃষ্ট রূপে বদ্ধ, ধ্রুপদ তারই একটি রূপ, (২) ধ্রুপদে সুর, বাণী, তাল ও ছন্দ দিকটি প্রকট। (৩) ধ্রুপদের বাণী, সুর, ছন্দ, তাল, একটি শাস্ত্রীয় নিয়মের মধ্যে নিবন্ধ (৪) এর একটি নিদিষ্ট ব্যকরণ আছে, রীতি, নিয়ম, শৈলী, স্টাইল, গায়কীর প্রথা ইত্যাদি আছে। (৫) বিভিন্ন ঘরানা পেক্ষিতে এক একটি নিদিষ্ট ঘরণায় আবদ্ধ। (৬) শাস্ত্রীয় ধারার অন্যতম শর্ত পদ গানের ট্র্যাডিশন আছে। সুতরাং এটি Traditional.(৭) Pull between tradition and modernity থেকেও এটি ঐতিহ্য থেকে আধুনিকতায় প্রবহমান। (৮) শাস্ত্রীয় ধারায় ধ্রুপদ শিক্ষার অন্যতম মান নির্ধারক গুরু পরম্পরা। (৯) যুগ পরিক্রমায় মধ্যযুগীয় ধারা থেকে প্রবাহমান হয়েও বিবর্তনের ধারায় এটি বেনারসের মতো ধ্রুপদী উৎস মুখে আজও প্রতিষ্ঠিত (১০) ঘরানার শুদ্ধতায় (সময়ের পরিক্রমায় বা বিশ্বায়ন সূত্রে) কিছু মিশেল ঘটলেও ধ্রুপদ খেয়ালের অনুসারী হয়নি। বরঞ্চ বলা যেতে পারে ধ্রুপদের কিছু উপকরণ শৈলী বা টেকনিক খেয়ালে গ্রহন করেছে বা খেয়ালে এসেছে। (১১) মধ্যযুগে চারটি বাণীর মধ্যে বিবর্তন সূত্রে কিছু পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং বিস্তৃত হলেও তাদের কিছু কিছু প্রভাব এখনও আছে।  (১২) নিবন্ধ দিকের উৎকৃষ্টতার আরও একটি কারণ হল গুরুমুখি বিদ্যায় ধ্রুপদে যারা পুরোনো  গুরু রয়েছে তারা সময়ের সঙ্গে সমঝােতা না করে এখন ধ্রুপদের পুরোনো  সংস্কারেই বিশ্বাসী। (সেটি গুরুমুখী শিখন শিক্ষনের Perfactions কুসংস্কার নয়) (১৩) নিবদ্ধ রূপটির প্রভাবে উৎকর্ষতার আর একটি দিক হল চমৎকারিত্ব ও বৈচিত্র। যেটা এসেছে নিবদ্ধ কারণে। (১৪) নিবদ্ধ গানের প্রভাবেউৎকর্ষতার আর একটি কারন হল অনিবদ্ধ বা আলাপ-আলপ্তির দিক। কারণ বাদ্যহীনতা এবং তালহীনতা ও ছন্দের প্রত্যক্ষ প্রভাব থেকে মুক্ত অনিবদ্ধ রূপটি থেকে নিবদ্ধ রূপে গমন। নিবদ্ধ রূপের প্রভাবকে অনেক বেশি প্রকাশিত করে যা ধ্রুপদকে আকর্ষণীয় করে তোলে (১৫) নিবদ্ধ রূপের দুটি দিক একটি Endugenous আর একটি Exogenous. অর্থাৎ অন্তঃছন্দ এবং বহিঃছন্দ। শুধুমাত্র অন্তছন্দটি অনিবদ্ধ রূপে ক্রিয়া করে আর নিবদ্ধ রূপে ক্রিয়া করে প্রত্যক্ষ ভাবে অন্তছন্দ থেকে বহি ছন্দে প্রকাশিত আনদ্ধ বাদ্য মাধ্যম দ্বারা।

সবশেষে এই কথা বলা যায় যে যেহেতু নিবদ্ধ শব্দের সাথে গান শব্দটি প্রাসঙ্গিকতা এসেছে। আমাদের আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে, যেহেতু আমার মনে হয় সঙ্গীত বা গানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের একটি বড় দিক হল প্রথমত যদি তা শাস্ত্রীয় কণ্ঠ সঙ্গীত হয় (ধ্রুপদ-খেয়াল) তবে সুর, তাল, এবং ছন্দই এখানে প্রধান। শুধু মাত্র বান্দিশে কথার যেটুকু স্থান আছে। তাও উচ্চ অর্থ বাহক নাও হতে পারে। আর যদি তা শাস্ত্রীয় যন্ত্র সঙ্গীত হয় তবে সেখানে কথার কোন স্থানই নেই, সুর, তাল, এবং ছন্দই মূল প্রাধান্য পায়। দ্বিতীয় যদি তা লাইট ক্ল্যাসিকাল light classical বা রাগের ছায়া আশ্রিত শাস্ত্রীয় ধারার গান হয় ঠুমরী, টপ্পা, গজল, ভজন বা গীত ইত্যাদি প্রকৃতির হয় তবেও সেখানে নিবদ্ধ রূপের উপকরণ, যথা কথা, সুর, তাল, ছন্দের ব্যবহার থাকে। তৃতীয় যদি তা বাংলা কাব্য সঙ্গীত বা বাংলা আধুনিক গান হয় সেক্ষেত্রেও কথা সুর, তাল, ছন্দের ভূমিকা নিবদ্ধ প্রভাবে আদর্শ উদাহরন। আর যদি লোকসঙ্গীত বা আঞ্চলিক গান হয় সেক্ষেত্রে কথা, সুর, তাল, ছন্দের ভূমিকা অপরিহার্য। (৪) আর নিবদ্ধ গানের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল – রবীন্দ্রসঙ্গীত, ডি. এল. রায়, ও রজনীকান্ত বা অতুল প্রসাদের গান।

যেখানে কাব্যময়তা, সুরময়তা তাল ও ছন্দময়তা সামগ্রিক ভাবে প্রভাবিত করছে এবং সম্পূর্ণতা দিয়েছে গান গুলো। ফলে একথা বলাই যায় যে নিবদ্ধ শব্দের আক্ষরিক অর্থ যখন সঙ্গীত প্রাসঙ্গিক হয় তখন শাস্ত্রীয় কণ্ঠ সঙ্গীত ধ্রুপদ ও খেয়াল বা যন্ত্র সঙ্গীত বা অন্য যেকোন গানকে তার আধারে রেখে, তার ঐতিহ্যের ধারা অক্ষুন্ন রেখে সেই সঙ্গীত বিষয়ক নিবন্ধের প্রভাবে প্রভাবান্বিত করে সেই বিষয়ের সম্পূৰ্ণায়ন ঘটায়।

অনিবদ্ধ রাগ রূপায়ণ/কণ্ঠসঙ্গীত অনিবদ্ধ আলাপ ধ্রুপদে অনিবদ্ধ গানের যে প্রভাব আছে সেটা খুবই প্রত্যক্ষ এবং সুস্পষ্ট। তার কারন শাস্ত্রীয় নিয়ম অনুযায়ী ধ্রুপদ গানের সূচনায় হয় অনিবদ্ধ বা আলাপ আলপ্তি দ্বারা, এর মাধ্যমে রাগের পরিচিতি প্রদান করা হয়। রাগ রূপায়নে শিল্পী যেমন এর দ্বারা রাগটির সাথে নিজে পরিচিত হন তেমনি শ্রোতাদের সাথে রাগের পরিচয় করিয়ে দেন। এখন প্রশ্ন হল এই পরিচিতির ভূমিকাটা তো অনিবন্ধের জায়গায় নিবদ্ধই করতে পারতো। কিন্তু কেন সেটা শাস্ত্রীয় ধারার নিয়ম অনুযায়ী নয়। এর উত্তরে বলা যেতে পারে শুধু শাস্ত্রীয় ধারা নয় যেকোন ক্ষেত্রেই আলাপ বা আলাপ্তি চারিতার মাধ্যমে যে পরিচয়ের প্রথম ভাগটি সেখানে মানুষ খুব ধীর স্থির ভাবে কথার আদান প্রদান ঘটায় শান্ত আচরনের মধ্যে দিয়ে আলাপ চারিতার ক্ষেত্রে। এই আলাপ এর মাধ্যমে যখন ক্রমে ঘনিষ্টতা বাড়ে বা সম্পর্ক তৈরি হয় তখন মানুষ প্রাত্যহিক সহজ সরল আনায়াস আচরনের মধ্যদিয়ে আপনত্ব প্রকাশ করে।

আলাপ চারিতার বা আলাপের এই প্রথা বা চেতনা, উৎসারিত মন এবং আচরন থেকেই সঙ্গীতের মধ্যে মনে হয় এই ধারনাটি এসেছে। কারন ধ্রুপদ গানে অনিবদ্ধ যে রূপটি সেটি ধীর লয় থেকে দ্রুত লয়ে পৌঁছাবারই একটা রূপ। এটিকে আমরা আর একটি বিষয়ের সাথে তুলনা করতে পারি তাহল প্রকৃতি এবং প্রকৃতির অন্তর্গত জীবন। যেমন প্রতিদিন যেমন সকাল হয় তার যে পরিবেশ তার একটি ধীর শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ। কর্মময়তা থাকে কিন্তু তাতে দ্রুততা থাকে না। বেলা বারার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি এবং প্রকৃতিস্থ জীবন জগতও ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এটি অনিবদ্ধ থেকে নিবন্ধে যাওয়ার একটি রূপ বা পথ, উদাহরণস্বরূপ আমরা বলতে পারি।

ধ্রুপদ গান যখন কোন মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় তখন শিল্পী এবং শ্রোতা এবং শিল্পীর সাথে বাদ্যযন্ত্রীরা ধীর স্থির ভাবে রাগ রূপায়নের মধ্য দিয়ে অনিবদ্ধ রূপটিকে শ্রবণ সুখে ইন্দ্রিয়জাত করতে থাকেন, সেখানে নেই কোন চঞ্চলতা, নেই কোন শব্দের বহিঃপ্রকাশ। শুধু সুর উপলন্ধ আর কিছু বাণী ও অন্তর ছন্দের সুখ অবগাহন করে। যেমন ভাবে ফালগু নদী স্রোত শ্রেণী। এই সময় শিল্পীর সাথে শিল্পীর এবং শিল্পীর সাথে শ্রোতাদের ভাব বিনিময় চলে রাগ রূপের Intervention দ্বারা, যেখানে শিল্পী এবং শ্রোতারমধ্যেখানে থাকে রাগ। তৃতীয় অস্তিত্ব হয়ে উভয়ের সাথে Interact করে। এর পরে স্তরেই যখননিবদ্ধ অংশটি শুরু হয় তখনই শ্রোতাদের এবং শিল্পীর এই পূর্বাভাব অর্থাৎ অনিবদ্ধ ভাবটি কেটে যায়।

বহিঃছন্দের প্রকোপ ও প্রভাবে শিল্পী এবং শ্রোতা উভয়ই জাগরনের দ্বিতীয় স্তর এবং চঞ্চল হয়ে ওঠে এবং সেই ধ্রুপদ গানে সঙ্গেই অন্যভাব মিশে যায় (এখানে জাগরনের দ্বিতীয় স্থান এর কথাটি বলা হলো প্রকরন যে প্রকৃতি জগত সেমানুষ বা পশু যেই হোক না কেন জাগরনের পরে প্রথম চোখ খুলে জড়তা কাটিয়ে সে দ্বিতীয় স্তরে যায় এবং তৃতীয় স্তর থেকে তার এনাটমি ফিজিওলজি স্বাভাবিক ক্রিয়া করতে শুরু করে) নিবদ্ধ এবং অনিবন্ধের মধ্যে প্রভেদ এটি। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত খেয়ালে নিবদ্ধ গানের প্রভাবই বেশি। সেক্ষেত্রে আলোচিত বিষয় নিবন্ধ গান হিসেবে খেয়াল যথেষ্টই উল্লেখযোগ্যতা পেয়েছেন। খেয়াল গানে যে রীতি এবং নিয়ম তাতে দেখা যায় যে খেয়ালে রাগের বাধন থাকলেও ধ্রুপদের মত রাগ বিস্তারে ধরা বাধা নিয়ম থাকে না। খেয়াল হল দুরন্ত দুর্বার এবং প্রাণউচ্ছল। খেয়াল শব্দটি থেকেই বোঝা যায় যে এর অর্থ খেয়ালী পনা। কিন্তু যদি আক্ষরিক অর্থে আমরা ধরি তবে দেখবো এটি একটি আরবি শব্দ। অর্থ হল কল্পনা, বিচার, ধ্যাণ। রাগের ধ্যাণ মূর্তি কল্পনা করে তাকে বিচার পূর্বক বিস্তারিত প্রকাশ করার নামই খেয়াল।

যতটুকু জানা যায় সঙ্গীত শাস্ত্রীয় গবেষণা গ্রন্থগুলি থেকে যে আমির খসরুই এর প্রচলন করেছিলেন তার পর প্রচারক হিসাবে পাই সুলতান হুষেণ শর্কী। ১৬২৮ থেকে ৬৬ পর্যন্ত সম্রাট শাহজাহানের দরবারে আমির খসরুর যে পদ্ধতিতে সেটি চালু ছিল। আনুমানিক ১৫৪৮ থেকে ১৬০৫ সম্রাট আকবরের সময় খেয়াল এর প্রচলন ছিল এবং শাহজাহানের দরবারে খেয়াল এর ঐ স্টাইলই জনপ্রিয়তা আনে। কিন্তু লোকপ্রিয়তা শব্দটি আগে ঔরঙ্গজেবের সময় থেকে। তবে খেয়াল এর চেয়ে বিশেষ পরিবর্ধিত রূপ সদারঙ্গের খেয়ালকে অনুসরন করেই হয় ।

নামে অনেক খেয়াল গান রচনা করে যায়। এই সময় থেকেই খেয়ালে বীন এর জোড় ও বাণীর উপর জোড় দিয়ে স্বরবিস্তারের সাহায্যে বোলতান যুক্ত হয়। খেয়াল ও ধ্রুপদের যত বাণী প্রযুক্ত হয়, যা রাগের ভাব, ভাষা ও তার কায়দা উপর নির্ভরশীল ছিল।সদারঙ্গের খেয়াল দুই তুক বিশিষ্ট ছিল। প্রথম হল স্থায়ী অঙ্গ দ্বিতীয়টি অন্তরা। এই অন্তরাই ধ্রুপদের আভোগের কায়দায় রচিত হত এবং অন্তরায় গীত রচয়িতার নাম থাকতো স্থায়ী, অন্তরা গাইবার পর। প্রথমে স্থায়ী পরে অন্তরার বিস্তার করা হয়। বিস্তারে গানের একটি পদ অথবা আকারের ব্যবহার করা হত নানা অলংকার ও গমকের ব্যবহার থাকতো। গানের ভঙ্গি তার ভাষা ও ভাবের উপর নির্ভর করে বিস্তার করা হত। সবশেষে দ্রুত গতিতে নানা ছন্দ ও অলঙ্কার প্রকাশ করা হতো। বর্তমানে বোলতান আকার যোগের তান নানা ধরনের তেহাই গমক ছন্দ ও তান সরগম ব্যবহার করা হতো।

খেয়াল এর ভাষা হল ব্রজভাষা, রাজস্থানী, হিন্দী, উর্দু, পাজারী, (হরী বোলী অনে) তবে ব্রজবুলি ভাষায় ব্যবহারই বেশী। যাতে খেয়াল সমস্ত আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে সমৃদ্ধ করতে পারে। তাছাড়া প্রশংসা নায়িকা ভেদ। প্রেম কাহিনী বর্ণনা দেখা যায়। ব্রজবুলি ভাষার ব্যবহার বেশি এবং ভাষার বিষয়বস্তুর মধ্যে নায়কের প্রশংসা নায়িকাভেদ প্রেম কাহিনী এবং প্রকৃতি বর্ণনাও থাকে। এই তালগুলি হল তিনতাল, এক তাল, ঝুমরা ইত্যাদি এছাড়া নানা ধরনের সওয়ারী এবং ঝাপতাল, আড়াচৌতাল প্রভৃতি তালের প্রচলন দেখা যায়। তবে খেয়াল এর যে প্রকৃতি তার সঙ্গে যেসব রাগ গম্ভীর এবং যাতে বিস্তারের সুবিধা আছে এবং অপন্যাসের প্রয়োগ সম্ভব সেই সব রাগই খেয়াল এর প্রকৃত শ্রেণী। চটুল, চপল জাতীয় ক্ষুদ্র রাগ খেয়াল এর পক্ষে বিশেষ উপযুক্ত নয় খেয়াল গানের বিভিন্ন ঘরানা আছে। দিল্লী ঘরানা, কওয়াল ঘরানা, খৈরবাদ ঘরানা, লক্ষৌ ঘরানা, তিলখড়ি ঘরানা পত্রালী ঘরানা আগ্রা ঘরানা, পাঞ্জাব ঘরানা, সাহারানপুর ঘরানা, বেনারস ঘরানা, বিষ্ণুপুর ঘরানা, রামপুর ঘরানা ইত্যাদি।

খেয়াল এর একটি রাগের উপস্থাপন পদ্ধতি বা রীতি, নিয়ম বা পক্রিয়া যা তা হল কোন একটি নির্দিষ্ট রাগে তার আলাপ করা হয় অর্থাৎ এই আলাপ অংশটি অনিবদ্ধ অবস্থায় থাকে। এই অনিবদ্ধ আলাপ নির্দিষ্ট রাগের নূন্যতম স্বর সমষ্টি দ্বারা রাগটির রূপটিকে ফুটিয়ে তোলা হয়। রাগটি প্রকাশ পেলে নিবদ্ধ অংশের বন্দিশ শুরু করা হয়। খেয়াল গান সাধারনত স্থায়ী এবং অন্তরা দুটি তুকেই গীত হয়।

স্থায়ী তুকটি গীত হয়ে মুখরাই এলে স্থায়ী মুখরা দেখিয়ে রাগ বিস্তার শুরু করা হয়। এই রাগ বিস্তার মধ্য ‘সা থেকে মন্দ্র এবং মন্দ্র থেকে মধ্য হয়ে তার সপ্তকে যেতে থাকে। এই অবস্থায় স্থায়ীর কথাগুলিকে নিয়ে রাগ রূপ অনুযায়ী এবং শাস্ত্রীয় নিয়মের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় রাগটি বিস্তার করা হয় বা রাগের পরিধিটি কে ব্যক্ত করা হয়। এই বিস্তার কালে তালের নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী রাগটির বান্দিশ এর লেখাটিকে বার বার দেখানো হয়। এই অবস্থায় তার সপ্তকের ‘সা এ পৌছালে অন্তরা তুকটির মুখরাটিকে গাওয়া হয়। এর পর চলে অন্তরার বিস্তার। এই বিস্তার এর পরিধি থাকে সাধারনত মধ্য মা বা পা থেকে তার সপ্তক হয়ে অতি তার সপ্তকে পৌছায়। এখানেও অন্তরা তুকের কথাগুলিকে নিয়ে বিস্তার করা হয়।

এই ভাবে অন্তরার বিস্তার শেষ হলে, অন্তরা তুকটি সমস্ত অংশ গেয়ে স্থায়ীতে পৌছালে স্থায়ী অংশের মুখরা দেখিয়ে সরগম, তান, বোলতাল এবং তালের বিভিন্ন ছন্দ প্রকাশ করা হয়। খেয়াল গানে সরগম অংশে রাগের আরোহন ও অবরোহন অনুযায়ী বিভিন্ন স্বরের combination দেখানো হয়। এই  combination দেখানো  কালে গলার পরিধিটি বা সপ্তকের সীমানার কোন নির্দেশ থাকে না। শিল্পী বা গায়কের নির্দিষ্ট ভঙ্গিমায় রাগরূপ ও শাস্ত্রীয় নিয়ম অনুযায়ী শিল্পী বা গায়ক গাইতে থাকেন। এর পর তান দেখানো  হয়। তান দেখানো  কালে আকার অনুযায়ী তান করাই শাস্ত্রীয় নিয়ম। এখানেও সপ্তকের কোন সীমানার নির্দেশ থাকে না। গায়কের মেজাজ ও রুচি অনুযায়ী তান দেখানো  হয়। এই তান সরগম দেখানো  কালে বান্দিশ এর বিভিন্ন কথাকে নিয়ে মাঝে মাঝে বোলতান এবং ছন্দের বিভিন্ন প্রকার দেখানো  হয়। এরপর দ্রত তিন তাল অংশ গীত হয় এবং সমগ্র রাগটি গায়ন কালে শেষ অংশে তেহাই দিয়ে শেষ হয়।

শিল্পী বা গায়ক বা গায়িকা শাস্ত্রীয় নিয়মরীতি পদ্ধতি অনুযায়ী খেয়াল গানটি পরিবেশন করে (সাধন পক্রিয়াটি অবশ্য আলাদা কিন্তু আলাদা হলেও শাস্ত্রীয় নিয়ম অনুযায়ী উপস্থাপন পক্রিয়া এবং পদ্ধতিটি শিক্ষন করা সাধন পক্রিয়ার মধ্যেই পরে। কারন practice বা অভ্যাস যেমন একটি রাগের বা রাগ রূপায়নের বিভিন্ন উপকরন ধরে ধরে ও করা যায় যেমন স্বর বিস্তার, সরগম, তান ইত্যাদি। কিন্তু এই সমস্ত উপকরনগুলি রাগ রূপায়নের শাস্ত্রীয় নিয়ম অনুযায়ী করাটাও সাধন স্তর বা ধাপের অঙ্গ) সহযোগী যন্ত্র হিসেবে থাকে তানপুরা, হারমোনিয়াম আর আনদ্ধ বাদ্য হিসাবে থাকে তবলা। যেহেতু খেয়াল গানের অধিকাংশ অংশটি নিবদ্ধ পর্যায়ে সেহেতু এখানে শুধু রাগ রূপ অনুযায়ী স্বর এবং শ্রুতি এবং সুর ক্ষেপনই নয় সঙ্গে তাল এবং ছন্দকে রক্ষা করার জন্য বাদ্য যন্ত্র হিসাবে তবলা থাকে। ধ্রুপদের ক্ষেত্রে পাখওয়াজ থাকে। (ধ্রুপদ হোক বা খেয়ালই হোক সঠিক সুরে রাগ রূপায়নের perfection এর সাথে তালের দিকটিও যথেষ্ট নিখুত ভাবে বিচার করা হয়। কারন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত হিসাবে খেয়াল এবং ধ্রুপদ উভয়ই তাদের নিজ নিজ উপকরণ এবং উপাদানের নিপুন প্রয়োগ ও ব্যবহারে সজাগ থাকে। সুতরাং খেয়াল গান প্রায় সবাই নিবদ্ধ পর্যায়ে (কিছু অংশ নিবদ্ধ) আর নিবদ্ধ বৈশিষ্ট্যের প্রভাব আছে। বলেই খেয়াল গান এতটা চিত্তকর্ষক যা সুর, তাল, লয়, ছন্দে সমন্বয়। এবার আসা যাক খেয়ালে অনিবদ্ধ গানের সম্পর্ক। খেয়ালে অনিবদ্ধ আলাপ আলপ্তির দিকটির যে প্রভাব তা হল আলাপের অংশটি।

যেখানে স্বর বা আকারান্ত দিয়ে রাগ রূপটিকে প্রকাশ করা হয়। পূর্বে সম্ভবতঃ সংস্কৃত শ্লোকের সাহায্যে আলাপ গাওয়া হতো। খেয়াল গীত রীতি প্রচলনের সূচনায় আলাপ গান ছিল সংক্ষিপ্ত। মাত্র দুই প্রকার, প্রকৃত ও রূপক আলাপ। এই প্রকাশের বা অনিবদ্ধ অংশটির ভূমিকা হল শিল্পী যেমন নিজে রাগটির সাথে আলাপ করেন অর্থাৎ এই সময় তার শিল্পী সত্ত্বা এবং অন্তঃসত্ত্বা উভয়ের সাথে একটি রাগের মাধ্যমে পরিচয় ঘটে। আর একটি দিক হল আলাপের মাধ্যমে গেয় রাগটির রূপতাত্ত্বিক সম্পর্কে শ্রোতাদের কাছে আলাপের মাধ্যমে পৌছে দেওয়া। এই সময় শুধু তানপুরাই বাজে কিন্তু ছন্দ রক্ষার্থে কোন বাদ্য ব্যবহার হয় না। (কিন্তু অনুভূতি দিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যায় আলাপের সময় একটি অন্তঃছন্দ কাজ করে। এর কারনটি হল অনিবদ্ধ রূপটি শিল্পীর গায়কী বা বাদ্য না ব্যবহারে প্রকাশিত হলেও প্রতিনিয়ত শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সাধনা ও উপস্থাপনায় অভ্যাসরত ব্যস্ত থাকায় শিল্পীর মধ্যে সবসময়ই সুর, তাল, লয়, ছন্দ, ঘুমে, স্বপনে, জাগরনে কাজ করে। যেমন একটা কথাই আছে যিনি প্রকৃত সঙ্গীত শিল্পী তার কথাবলা, চলাফেরা সমস্তকিছুতেই সঙ্গীতে মূল তিনটি উপকরন সুর, তাল, ছন্দ কাজ করে)।

খেয়াল গানে অনিবদ্ধ প্রভাবটি কতকগুলি দিক আছে। প্রথমত এই অনিবদ্ধ বা আলাপ আলপ্তির দিকটি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে শাস্ত্রদ্বার নির্দেশিত রূপ। দ্বিতীয়ত রাগ রূপায়নের সূচনায় যে আলাপ সেটি শুধু রাগের সাথে শিল্পী বা শ্রোতাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব বহন করেনা, করে রাগটিকে চেনানো র কাজও এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সমাজ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে অধিক প্রতিষ্টার কাজ। তৃতীয়ত আলাপ বা আলপ্তি যেহেতু অনিবদ্ধ অংশ এখানে অন্তর ছন্দ রক্ষিত হলেও কোন বাদ্য মাধ্যমের দ্বারা তান বা ছন্দ রক্ষিত হয় না সেহেতু লালহীন সুর সঞ্চারের বারেই তালবদ্ধ সুরসঞ্চার যেমন নিবদ্ধ রূপকে উজ্জ্বল ভাবে প্রকাশিত করে তেমনি অনিবদ্ধ রূপকেও উজ্জ্বল ভাবে প্রকাশিত করে। চতুর্থত অনিবদ্ধরূপের প্রভাবটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এর প্রভাব শিল্পী এবং শ্রোতা উভয়কেই প্রভাবিত করে যেহেতু নিবদ্ধ রূপ নিবদ্ধ রূপের আধার। পঞ্চমত খেয়ালে নিবদ্ধ গানের প্রভাবের আর একটি দিক হল এটি একদিকে যেমন রাগ রূপকে আত্মস্থ করে অন্যদিকে রাগ রূপের মধ্যে বিভিন্নতা আনে।

(অনিবদ্ধ প্রভাবটি ধ্রুপদ এবং খেয়াল এর মধ্যে ধুপ দেই বেশি প্রভাবিত সেই সূত্রে বলা যায় খেয়ালে কম। কিন্তু সময় এর বিচারে কম বেশী প্রভাব খুব একটা ছােট বড় করে না। কারন ধ্রুপদের আলাপ অংশটি বেশী কিন্তু খেয়ালে আলাপ অংশটি কম থাকলেও ঐ কম অংশটিকেই শিল্পী ও শ্রোতা অনেক বেশী অনুভব করে।

তথ্য সূত্র

১) লক্ষীণারায়ন ঘোষ, গীত – বাদ্যম প্রতাপ নারায়ন ঘোষ : (প্রথম খন্ড) ; পৃঃ ১০৪

২) তদেব ; পৃ ১১০

৩) ননীগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় ; সঙ্গীত দর্শিকা(চতুর্থ সংস্করন) ; অশােক বন্দ্যোপাধ্যায় ; শ্রী রামকৃষ্ণ আশ্রম পৃ ১৮

৪) লক্ষীনারায়ন ঘোষ, গীত – বাদ্য ; প্রতাপশারায়ন ঘোষ : (প্রথম খন্ড) ; পৃঃ ১১১

৫) তদেব ; পৃ ১১৩

৬) তদেব ; পৃ ১১৩

৭) তদেব ; পৃ ১১৩

৮) শ্রী রাজ্যেশ্বর মিত্র ; মুঘল ভারতের সঙ্গীত চিন্তা ; শ্রী জ্যোৎস্না সিংহরায় , লেখক সমবায় সমিতি পৃ ৫৩ – ৫৪

৯) গোপেশ্বর বন্দোপাধ্যায় ; সঙ্গীত চন্দ্রিকা ; রবীন্দ্র ভারতী পৃ ৪৩০

১০) লক্ষীনারায়ন ঘোষ, গীত বাদ্য ; প্রতাপরায়ন ঘোষ : পৃঃ ১১৪

১১) অমল দাস শর্মা ; সঙ্গীত মনিষা ; কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি ; কলিকাতা পৃঃ ৩০