November 1, 2020

গানের সূত্রে নাট্যের মালা’ এবং নাট্যের সূত্রে গানের মালা’ : একটি সমীক্ষা

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

ডঃ ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, ভার প্রাপ্ত অধ্যক্ষ, পদ্মজা নাইডু কলেজ অফ মিউজিক‌ বর্ধমান

(এক)

তিনটি গীতিনাট্য বাল্মীকি-প্রতিভা, ‘কালমৃগয়া এবং মায়ার খেলা সম্পর্কে আমার এই আলোচনা। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের পড়তে হয় গানের সূত্রে নাট্যের মালা ও নাট্যের সূত্রে গানের মালা সম্বন্ধে। আলোচ্য তিনটি গীতিনাট্যের কোনটিতে নাটক হচ্ছে সূত্র এবং গান হচ্ছে মালা, আবার কোনটিতে গান হচ্ছে সূত্র এবং নাটক হচ্ছে মালা। বর্তমান কালের পরীক্ষার্থীরাও একই বিভ্রমে বিভ্রান্ত, কলম ধরা ডান হাত গালে দিয়ে ভাবতে বসে, উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে হয়ে যাবে না তাে! এই বিভ্রান্তি আসে কবিরই আলঙ্কারিক ভাষাকে ভালোভাবে বুঝতে না পারার জন্য।

নৃত্যনাট্য 'কালমৃগয়া' মঞ্চস্থ | সারাদেশ বিনোদন | The Daily Ittefaq
কাল মৃগয়া

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পিয়ানোর সুর ঝঙ্কার কে অবলম্বন করে, তরুণ রবীন্দ্রনাথ এবং অংশত অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী বাল্মীকি-প্রতিভার গানগুলো রচনা করেন। নাট্য ও সংগীতের অভিনয়, সংযোজন, বিয়োজন চলেছে বেশ কিছু দিন। বছরখানেক পর, ঐ একই আদলে রবীন্দ্রনাথ রচনা করলেন কালমৃগয়া। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ২১ বছর। বাড়তি যোগ হােলাে আপন কল্পনায় বনদেবতা ও বনদেবী নৃত্যগীত। পাঠকবৃন্দ সবাই জানেন রামায়ণ উভয় গীতিনাট্যেরই আখ্যানগত অবলম্বন। আরো বছর চারেক পরে, কালমৃগয়ার কয়েকটি গানকে বাল্মীকি-প্রতিভার নতুন সংস্করণে যোগ করা হােলাে। এখন যেটা আমরা গীতবিতানে ও স্বরবিতানে দেখতে পাই।

আরো ছয় বছর পর (বঙ্গাব্দ ১২৯৫, ইংরেজি ১৮৮৮), কবি সংগীতরসে মগ্ন হয়ে রচনা করলেন মায়ার খেলা। এর আখ্যান পৌরাণিক নয়, ভাববিলাসী যুবক-যুবতীর প্রেমাভিব্যাক্তি। সুতরাং, উক্ত তিনটি গীতিনাট্য রচনার ইতিহাস আখ্যান ও গীতশৈলীর তথা নাট্যশৈলীর পারস্পরিক তুলনা সম্পর্কে রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হার্বাট স্পেনসরের The origin and function of music” প্রবন্ধ পাঠ করেই বুঝি রবীন্দ্রনাথ ‘বাল্মীকি-প্রতিভা রচনা করেছেন। কালানুক্রম লক্ষ্য করলেই বােঝা যাবে, এই ধারণা একেবারেই ভুল। ২৬শে ফেব্রুয়ারি, ১৮৮১, ঠাকুরবাড়ীতে তেতলার ছাদে বিদ্বজন সমাগমে বাল্মীকি-প্রতিভা প্রথম অভিনীত হয়েছিল। বিদ্বজন সমাগম উপলক্ষে দর্শকাসনে উপস্থিত ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রাজশেখর বসু, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রাজকৃষ্ণ রায়, কৃষ্ণমােহন বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলাম্বর মুখােপাধ্যায়, তারকনাথ পালিত, সৌরিন্দ্রমােহন ঠাকুর, মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন, কৃষ্ণবিহারী সেন সহ তৎকালীন কলকাতার বহু জ্ঞানীগুণী মানুষ। বাল্মীকি-প্রতিভার এই প্রথম অভিনয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বাল্মীকির ভূমিকায় এবং ভ্রাতুস্পুত্রী প্রতিভা দেবী (সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠা কন্যা) বালিকা তথা সরস্বতীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

১৯শে এপ্রিল, ১৮৮১, রবীন্দ্রনাথ সংগীত ও ভাব প্রবন্ধটি, বেথুন সােসাইটির আমন্ত্রণে, মেডিকেল কলেজ হলে, সংগীতসহ পাঠ করেছিলেন। তার বক্তব্যের বিষয় ছিল, গানের কথাকেই গানের সুরের দ্বারা পরিস্ফুট করে তােলা কণ্ঠসংগীতের মুখ্য উদ্দেশ্য। বক্তব্যটি সমর্থনের চেষ্টায় তরুণ বক্তা রবীন্দ্রনাথ আগাগােড়াই নানাপ্রকার সুর দিয়ে, নানা ভাবের গান গেয়েছিলেন। সুতরাং, অনায়াসে অনুমান করতে পারি দস্যুদের উন্মাদনার সুরের গান, বাল্মীকির ক্রোধ ও আদেশের গান, বালিকার কাতর রােদনের গান, প্রথম দস্যুর ভাড়ামির গান সবই তিনি গেয়েছিলেন।

Balmiki Pratibha will publish from Visva Bharati - Anandabazar

সংগীত ও ভাব প্রবন্ধ রচনার পরে হার্বাট স্পেনসরের রচনাবলী ; ‘Scientific political and Speculative, Volume : I, II & III’ 41 2R Volume এর অন্তর্গত ‘The origin and function of music’ প্রবন্ধটি তিনি গভীর মনােযােগে অধ্যয়ন করলেন। কবি নিজেই বলছেন, এই প্রবন্ধে স্পেনসরের যে সব মত অভিব্যক্ত হয়েছে সেগুলি, আমার মতের সমর্থন করে, এবং অনেকস্থলে উভয়ের কথা এক হইয়া গিয়াছে।

Valmiki Pratibha enthrals UK | Asian News from UK

তাহলে, সমর্থন আর এক হয়ে যাওয়ার অর্থ কি প্রভাবিত হয়ে বাল্মীকি-প্রতিভা রচনা? Chronology তেই দেখা যাচ্ছে, বাল্মীকি-প্রতিভার প্রথম অভিনয় ২৬শে ফেব্রুয়ারি, ১৮৮১। মেডিকেল কলেজ হলে সংগীত ও ভাব প্রবন্ধ পাঠ করা হয় প্রায় দু’ মাস পরে, ১৯শে এপ্রিল, ১৮৮১। ঠিক তারপরে হার্বাট স্পেনসরের “The Origin and function of Music প্রবন্ধটি অধ্যয়ন (পৃষ্ঠা : ২১০-২৩৮)। তাহলে, একথা অনস্বীকার্য যে, বাল্মীকি-প্রতিভা রচনায় হার্বাট স্পেনসরের কোনােরকম প্রভাব ছিল না।

Official Website of West Bengal Correctional Services, India - Memorable  Moments
বাল্মীকি-প্রতিভা

‘বাল্মীকি-প্রতিভা রচনার ৩১ বছর পরে অর্থাৎ ১৯১২ খৃষ্টাব্দে কবি ‘গান সম্বন্ধে প্রবন্ধটি রচনা করেছিলেন, বন্ধুবর রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ‘প্রবাসী পত্রিকার বৈশাখ ১৩১৯ (১৯১২) বঙ্গাব্দে প্রকাশের জন্য। ৩১ বছর আগের স্মৃতি রােমন্থন করে ‘ছিন্নপত্রাবলীতে কবি। লিখছেন, “বেথুন সােসাইটির আমন্ত্রণে মেডিকেল কলেজ হলে আমি প্রবন্ধ পাঠ করিয়াছিলাম। সভাস্থলে এই আমার প্রথম প্রবন্ধ পড়া। সভাপতি ছিলেন বৃদ্ধ রেভারেণ্ড কৃষ্ণমােহন বন্দ্যোপাধ্যায়।” কবির স্মরণে বিশেষভাবে উদিত হােলাে রেভারেণ্ড বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বন্দে বাল্মীকি কোকিলম’ সাধুবাদ। আসলে, রবীন্দ্রনাথ শুধু কবি ছিলেন না, শুধু সংগীতকার ছিলেন না, নিজে ছিলেন অত্যন্ত সুকণ্ঠগায়ক।

Balmiki Pratibha from Punascha (St. Louis, USA) - YouTube
বাল্মীকি-প্রতিভা

একটি মূল্যবান প্রশ্ন আমাদের মাথায় আসে যে, বাল্মীকি-প্রতিভা আগে রচিত হলেও গীতবিতানে কালমূগয়া আগে আছে কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে যেটা মনে হয় তা হল, কালমৃগয়ার বনদেবীদের ধারণাটি বাল্মীকি-প্রতিভার দৃশ্যে দৃশ্যে এসে গেল, ফলে বাল্মীকি-প্রতিভার আয়তন অনেকখানি বেড়ে গেল। নতুন বাল্মীকি প্রতিভার প্রথম দৃশ্যটাই অরণ্য। যেখানে অশরীরি বনদেবীরা শরীর ধারণ করে গাইছে, সহে না, সহে না, কাঁদে পরাণ। সাধের অরণ্য হােল শ্মশান। প্রভাত কুমার মুখােপাধ্যায়ের সমীক্ষায় আমরা অবগত হই, বাল্মীকি প্রতিভার পরিবর্তিত সংস্করণটির অভিনয়ে ঠাকুরবাড়ির তােড়জোড় ও দর্শকদের মুগ্ধতা এত বেশী প্রাবল্য পেয়েছিল যে, ‘কালমৃগয়া প্রায় অচলিত (Obsolete) হয়ে গিয়েছিল। ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর উদ্যোগে কালমৃগয়া’র প্রতি কবির তথা ঠাকুরবাড়ীর অন্যান্য অভিনেতা অভিনেত্রীদের দৃষ্টি পুনরায় খুলে গেল। তারপর থেকে কালমৃগয়া’ ও ‘বাল্মীকি-প্রতিভা দুটি গীতিনাট্যই অভিনীত হয়ে আসছে।

Children stage Tagore's Kal Mrigaya | The Daily Star

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯৬০-৬১ সালে রবীন্দ্র জন্ম শতবর্ষে কলকাতায় মারকাস্ স্কোয়ারে, বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনের উদ্যোগে এবং শান্তিনিকেতনে ‘কালমূগয়া অভিনীত হয়। অভিনয়ের এক-দেড়মাস আগে থেকে সংগীতভবন মঞ্চে এই গীতিনাট্যটির মহড়া চলেছিল। এই গীতিনাট্যে অন্ধমুনীর গান গেয়েছিলেন, তখনকার সংগীতভবনের তৃতীয়বর্ষের ছাত্র সিতাংশু রায়, দশরথের গান গেয়েছিলেন, তখনকার সংগীতভবনের চতুর্থবর্ষের ছাত্র শীতলপ্রসাদ মুখােপাধ্যায় (শীতলদা), অন্ধমুনীর ভূমিকায় মঞ্চে অভিনয় করেছিলেন তখনকার বিদ্যাভবনের ছাত্র সুপ্রিয় ঠাকুর এবং দশরথের ভূমিকায়, তখনকার পাঠভবনের দশম শ্রেণীর ছাত্রী নন্দিনী মুখােপাধ্যায় (পুরুষ সাজানাে হয়েছিল)। আজকের প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী প্রমিতা রায় (মল্লিক) এবং আলপনা রায়চৌধুরী (রায়) শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় ও সংগীত উভয়দিকেই অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং শর্মিলা রায় (পােমাে) বনদেবতার গান গেয়েছিলেন। আমার রবীন্দ্রসংগীত গুরু অধ্যাপক সিতাংশু রায়ের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানতে পারি, যে ঐ গীতিনাট্যের মহড়ায় এক- দেড়মাস ব্যাপী প্রত্যহ পাঠভবন সহ অন্যান্য বহু মানুষ সংগীতভবন মঞ্চে মহড়া দেখতে আসতেন এবং অন্ধমুনীর পুত্রবিয়ােগের পরে অভিনয় ও গান চলাকালীন পাঠভবনের ছাত্র-ছাত্রীরা অঝাের নয়নে কান্নায় ভেঙে পড়ত। অর্থাৎ এই ভীষণ করুণ রসাত্মক গীতিনাট্যটি কতখানি প্রভাব ফেলেছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়।

নাট্যেৎসবে আজ নৃত্যনাট্য 'মায়ার খেলা'
মায়ার খেলা

আর, বাল্মীকিপ্রতিভার সাফল্য প্রসঙ্গে আমার দেখা প্রত্যক্ষ ঘটনা। অধ্যাপক দিলীপ সিংহ মহাশয় উপাচার্য থাকাকালীন, বিশ্বভারতীতে গৌরপ্রাঙ্গণের পূর্বদিকে মঞ্চ বেঁধে, নতুন চিন্তাভাবনায় বাল্মীকিপ্রতিভা গীতিনাট্য বসন্তোৎসব উপলক্ষে মঞ্চস্থ হয়েছিল। আমি মঞ্চসজ্জা এবং আলােকসম্পাতের দায়িত্বে ছিলাম। ঐতিহ্যমণ্ডিত ঘণ্টাতলার বটবৃক্ষের নীচে বাল্মীকির কালিপ্রতিমা, মঞ্চে নীচের দিক থেকে লক্ষ্মী, সরস্বতীর আবির্ভাব ও অন্তর্ধান অভূতপূর্ব সাফল্য এনে দিয়েছিল। এই গীতিনাট্যে ব্যাধের ভূমিকায় স্বয়ং উপাচার্য দিলীপ সিংহ এবং আমার রবীন্দ্রসংগীত গুরু সিতাংশু রায় অভিনয় করেছিলেন। দস্যুদলে বিভিন্ন চরিত্রের সঙ্গে অধ্যাপক কে. যতীন্দ্র সিং (জিতেনদা), অধ্যাপক শংকরনারায়ণ এর নৃত্য এবং প্রথম দস্যু ও দ্বিতীয় দস্যু যথাক্রমে অধ্যাপক অশোক গাঙ্গুলী ও সৌরেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় দর্শকদের মনে আলােড়ন তুলেছিল। সমগ্র নাটকটি পরিচালনায় শ্রী পরিতােষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান অনস্বীকার্য। কালমৃগয়া ও বাল্মীকিপ্রতিভার সফলতার মাত্র এই দুটি উদাহরণ আমার এই সমীক্ষাটিকে তাৎপর্যমণ্ডিত করে তুলবে পাঠকদের মনে এই আশা রাখি।

banglanewspaper

(তিন)

নাট্যের সূত্রে গানের মালাই হােক অথবা গানের সূত্রে নাট্যের মালাই হােক, মায়ার খেলা গীতিনাট্যটি এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রচনা। মায়াকুমারীদের প্রথম গানেই আমরা সেটা প্রত্যক্ষ করি। মায়াজাল, স্বপনচনা, কুহক-আসন, নরনারীহিয়ার মায়াপাশ, মান-অভিমানের অলীক খেলা তথা কুহক স্বপন খেলা সমগ্র মায়ার খেলা গীতিনাট্যের মুখবন্ধ তৈরী করে দিচ্ছে। দ্বিতীয় দৃশ্যে গানের সুরেই শান্তা অমরকে বলছে

‘সুখে ঢলো ঢলাে, বিবশ বিভল, পাগল নয়নে

তুমি চাও কারে চাও

মায়ার তরণী বাহিয়া যেন গাে মায়াপুরী পানে ধাও’

অমরের প্রত্যুত্তর :

‘জীবনে আজ কি প্রথম এল বসন্ত।

মায়াকুমারীরা প্রবেশ করেই অমরকে বলছে :

কাছে আছে দেখিতে না পাও,

তুমি কাহার সন্ধানে দূরে যাও।’

এরকম ভাববিহ্বল শুরুতেই বােঝা যাচ্ছে, সমগ্র গীতিনাট্যটি এক অভিনব মায়ার খেলা বা Illusion Play । শান্তার পরবর্তী গান কথায়, সুরে, তালে এমনই চমৎকার যে পৃথক গান হিসেবেও এটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। গানটি –

‘আমার পরাণ যাহা চায়,

তুমি তাই, তুমি তাই গাে।’

MAYAR KHELA: A complex love story woven in melody | Daily Star

মায়ার খেলা’ গীতিনাট্য রচনার একটি চিত্তাকর্ষক ইতিহাস আছে। তৎকালীন সখীসমিতির পক্ষ থেকে ডঃ পি. কে. রায়ের, সহধর্মিনা সরলা রায়, রবীন্দ্রনাথকে অনুরােধ করেন শুধুমাত্র মহিলাদের দ্বারা অভিনীত হবে এমন একটি গীতিনাট্য রচনা করে দিতে। ঠাকুরবাড়ীতে পারিবারিক স্মৃতি নামে একটি বড় এবং মােটা খাতা থাকতাে নানাজনে সেটিতে নানান কথা লিখতেন। বলাই বাহুল্য তরুণ রবীন্দ্রনাথের লেখাই পারিবারিক স্মৃতির খাতায় বেশী থাকতাে। “মায়ার খেলা’র কল্পনা, অনুপ্রেরণা ও রূপায়নে সখী-সমিতি, সরলা রায় এবং পারিবারিক স্মৃতির ভূমিকা অনেকখানি।

নাট্যেৎসবে আজ নৃত্যনাট্য 'মায়ার খেলা'
মায়ার খেলা

১২৯৫ বঙ্গাব্দের পূজার অবকাশে কবি দার্জিলিঙে যখন বেড়াতে গিয়েছিলেন তখনই সখীসমিতির তথা সরলা রায়ের অনুপ্রেরণা অনুযায়ী কবি “মায়ার খেলা’র কয়েকটি গান রচনা করে ফেলেছিলেন। কলকাতায় ফিরে এসে কার্তিক অগ্রহায়ণ ও পৌষের মধ্যে তিনি মায়ার খেলা’ গীতিনাট্যটিকে সমাপ্ত করে ফেললেন। পৌষের মহিলা শিল্পমেলায় এটি অভিনীত হয়। বলাইবাহুল্য গানগুলি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই শিখিয়েছিলেন, গীতিনাট্যের সমস্ত অভিনয় পদক্ষেপ, হস্ত-সঞ্চালন এবং অভিব্যক্তিসহ।

শুধুমাত্র মহিলাদের দ্বারাই এটি অভিনীত হয়েছিল। গানের প্রথম লাইনটি হচ্ছে : উপভােগ, সুখ প্রেমের সমার্থক নয়। মায়াকুমারীদের শেষ গান-

‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম

প্রেম মেলে না।’

আদর্শ প্রেম হচ্ছে জীবনের সুখ, দুঃখ, উত্থান-পতন, হাসিকান্না সব কিছুর মধ্যে স্ত্রী-পুরুষ উভয উভয়কে ভালােবাসবে। ‘নলিনী গদ্যনাটকে এই Moral এর সূত্রপাত। আর মায়ার খেলায় অমর, অশােক, কুমার এবং শান্তা, প্রমদা ও সখীগণের নব যৌবনের ঘাত-প্রতিঘাতে এর পূর্ণতা। সপ্তম ও শেষ দৃশ্যে অন্যান্য পুরনারী ও পৌরজন অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে গেয়েছে কবির একটি বিখ্যাত গান : ‘এস এস, বসন্ত, ধরাতলে’।

লক্ষ্য করবেন বিশাল কলেবরের এই গানটি, কবির শেষ বয়সে রচিত নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদাতেও আরাে পরিপূর্ণভাবে আছে। প্রভাবের কথা যদি এসেই যায়, আমি বলবাে তরুণ রবীন্দ্রনাথের প্রভাব, বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথে গিয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। তাছাড়াও বলি, শেষ বয়সে কবি গীতিনাট্য “মায়ার খেলা’কে নৃত্যনাট্যে রূপায়িত করেছিলেন। সেখানেও এই গানটির কিছুটা অংশ স্থান পেয়েছে। এই গানটির প্রসঙ্গে বিশেষভাবে মনে পড়ে, শান্তিদা (অধ্যাপক-শিল্পী শান্তিদেব ঘােষ) অবসর গ্রহণের পরে, বৃদ্ধবয়সে গৌরপ্রাঙ্গণের মঞ্চে বসন্তোৎসবে দণ্ডায়মান অবস্থায় মাত্র একবারই এস এস, বসন্ত ধরাতলে গানটির চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্যের Versionটি একক কষ্টে যথাযথ গীতশৈলীতে গেয়েছিলেন।

এই প্রসঙ্গে আরাে একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা আমার পূর্বসুরীদের কাছ থেকেই শুনেছি। বিশ্বভারতীর সংগীতভবনের রবীন্দ্রসংগীত বিভাগের সবচেয়ে দরদী ও পরিশ্রমী অধ্যাপক ছিলেন বীরেন্দ্রনাথ পালিত তথা বীরেনদা। তিনি স্বেচ্ছায়, দু-দিন সন্ধ্যায়, সমগ্র আশ্রমে যাঁরা গান শিখতে ইচ্ছুক তাদের ক্লাস নিতেন। সংগীতভবন সমেত কলাভবন ও বিদ্যা-শিক্ষাভবন অধ্যাপক অধ্যাপিকা ও ছাত্রছাত্রীদের অত্যন্ত নিষ্ঠাসহকারে ও সানন্দে গান শেখাতেন। এস এস, বসন্ত ধরাতলে গাটি বীরেনদার শেখানাে ভঙ্গিতে এখনাে অনেকের কষ্ঠে আছে। এই ক্লাসে অংশগ্রহণকারী অন্তত জনা কুড়ির মধ্যে উল্লেখযােগ্য দর্শন বিভাগের অধ্যাপক প্রদ্যোৎ কুমার মুখেোেপাধ্যায়, সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপিকা নন্দিতা সরকার, পাঠভবনের অধ্যাপক সিতাংশু রায়, শুভ্রা মুখােপাধ্যায় (ঠাকুর), উষা সেনগুপ্ত (মুখােপাধ্যায়), বােলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রশান্ত মুখােপাধ্যায় প্রমুখ।

শুধু পুঁথিগত অধ্যয়ণ থেকে নয়, আমি তথা আমাদের বেশ কয়েকজনের সংগীত-স্মৃতির মালা গেঁথে এই সমীক্ষাটির উপসংহার টানলাম।

লেখক পরিচিতি :

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুমােদিত পদ্মজা নাইডু কলেজ অফ মিউজিকের শাস্ত্রীয় সংগীতের (কণ্ঠ) সহকারী অধ্যাপক ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ।