রাজ্য দখল থেকে কোভিড ১৯ : শিল্প ও শিল্পীর ভিবিষ্যৎ
দেবাশিস মণ্ডল
কোভিড ১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউ এসে হাজির হয়েছে আমাদের দেশে। পশ্চিমবঙ্গ আক্রান্ত। আক্রান্ত সারাদেশের সমস্ত ভাষাভাষী, ধর্ম ও বর্ণের মানুষ। এক বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। WHO অনেক আগেই আমাদের সতর্ক করেছিল করোনার এই দ্বিতীয় ঢেউ আসতে চলেছে বলে। দেশের প্রধান কর্তাব্যক্তিরা জানতেন, কিন্তু তারা এ দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ছিলেন। তারা সবাই প্রায় ব্যস্ত ছিলেন কিভাবে একেকটি রাজ্যকে নতুন করে দখল করে নেওয়া যায়। রাজতন্ত্রের অবসান হলেও এখনো আমাদের ভারতে ক্ষমতা দখলের রাজনীতি আর হিংস্রতা একটুও কমেনি। বরঞ্চ নতুন কৌশলে এরা সিদ্ধহস্ত এবং মানুষকে কিভাবে বোকা বানিয়ে তাদের সমর্থন আদায় করতে হয় সে ব্যাপারে তারা নিজেরা, তাদের অর্থবলও যে সমস্ত গণমাধ্যমগুলি আছে, সেগুলিকে মিথ্যা বলার জন্য যা যা যোগান দেওয়া দরকার, সেসব যোগান দিতে তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তাই কিভাবে মানুষের সমর্থন নিয়ে রাজ্য দখল করা যায়, সে ব্যাপারে তারা সমস্ত শক্তি এবং সমস্ত বুদ্ধিকে প্রয়োগ করেছেন। লোকবল অর্থবল এবং কুটকৌশল কোন কিছুতেই তাদের অভাব হয়নি। কত মানুষের প্রাণ গেল? অনাহার নিপীড়িত মানুষেরা গুলি, বোমা আর বন্দুকের আঘাতে প্রাণ হারালেন! পথে প্রান্তরে মানুষহুলি পড়ে রইলেন। কত মা এর কোল খালি হল। নেতারা লাভবান হলেন। মা, স্ত্রী বা শিশু সন্তানের কান্না, চোখের জলে বিভিন্ন মাপের নেতাদের কারো মন ভিজলো না। ক্ষমতার দম্ভে এরা হত্যার পক্ষে কত যুক্তি দিলেন। হায় ছায়াবৃতা, ঘোমটার নীচে কী বীভৎস রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করলাম!?
দেশের যারা মাথা, তারা এতোটুকুও সামাজিক ও মানসিক যন্ত্রণার কোন কিছুকেই আঁচ করতে পারলেন না। বড় পুঁজির ব্যবসায়ীরা, তারাও এই এক বছরে তাদের লাভের পরিমাণ যথেষ্ট বাড়িয়ে নিতে পেরেছেন। যারা সরকারি মাসোহারা পেয়ে থাকেন তাদের খুব একটা অসুবিধা হয়নি। কিন্তু যারা বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন, যারা দিন আনে দিন খায়, যারা দূরে অন্য রাজ্যে কাজ করে মাসে মাসে পরিবারের কাছে টাকা পাঠান, যারা লোকের বাড়িতে কাজ করে মাস গেলে দুই তিন হাজার টাকা আয় করেন, যারা ঠেলা রিক্সা চালান, যারা ছোটখাটো বিভিন্ন ধরনের কাজের সাথে যুক্ত তারা কাজ হারিয়ে ভয়ানক সমস্যার মধ্যে চলেছেন। আর সমস্যার মধ্যে পড়েছেন শিল্পীকূল। যাঁরা প্রতিদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য নিজেদেরকে অনেক সাধনা করে গড়ে তুলেছেন, তাঁরা একটু একটু করে নিজেদের সময় গুলিকে ব্যয় করেছেন নিজেদের দক্ষতা ও মেধাকে সম্পূর্ণ প্রয়োগ করে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লক্ষ্যে। তাঁরা আজ বড়ো অসহায়! ভয়ানক বিড়ম্বনার মধ্যে চলতে হচ্ছে তাদের! যারা দিন আনেন দিন খান, তাদের জন্য রেশন ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের জন্য ১০০ দিনের কাজে রয়েছে, কিন্তু এইসব নামী ও অল্প নামী শিল্পীদের জন্য কোথাও কিছু নেই। তারা না পারেন বলতে, লাইনে দাঁড়িয়েসাহায্য চাইতে, না পারেন সংসার চালাতে। তাদের যা-কিছু সহায়-সম্বল ছিল গত এক বছরে সম্পূর্ণ নিঃশেষিত হয়ে গেছে। তারা আশা করেছিলেন আস্তে আস্তে এই দুর্দশার অন্ত হবে এবং পুনরায় শিল্পীকূল হয়তো ক্রমে বেশি বেশি করে কাজ করে নিজেদের আর্থিক অবস্থা কে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গ প্রবলভাবে সারাদেশে আছড়ে পড়ায় এবং সরকারি উদাসীনতার কারণে তার ভয়াবহ আকার এদের দিশাহারা করে তুলেছে। এই অবস্থায় শিল্পীদের পাশে কে দাঁড়াবে? কে এই সব শিল্পীদের জন্য মুক্ত হস্তে দান করবে? কারা এইসব শিল্পীদের অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে? কারা এই সব শিল্পীদের অনুষ্ঠানকে মর্যাদা দেবে?
WHO অনেক আগেই আমাদের সতর্ক করেছিল করোনার এই দ্বিতীয় ঢেউ আসতে চলেছে বলে। দেশের প্রধান কর্তাব্যক্তিরা জানতেন, কিন্তু তারা এ দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ছিলেন। তারা সবাই প্রায় ব্যস্ত ছিলেন কিভাবে একেকটি রাজ্যকে নতুন করে দখল করে নেওয়া যায়। রাজতন্ত্রের অবসান হলেও এখনো আমাদের ভারতে ক্ষমতা দখলের রাজনীতি আর হিংস্রতা একটুও কমেনি। বরঞ্চ নতুন কৌশলে এরা সিদ্ধহস্ত এবং মানুষকে কিভাবে বোকা বানিয়ে তাদের সমর্থন আদায় করতে হয় সে ব্যাপারে তারা নিজেরা, তাদের অর্থবলও যে সমস্ত গণমাধ্যমগুলি আছে, সেগুলিকে মিথ্যা বলার জন্য যা যা যোগান দেওয়া দরকার, সেসব যোগান দিতে তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তাই কিভাবে মানুষের সমর্থন নিয়ে রাজ্য দখল করা যায়, সে ব্যাপারে তারা সমস্ত শক্তি এবং সমস্ত বুদ্ধিকে প্রয়োগ করেছেন। লোকবল অর্থবল এবং কুটকৌশল কোন কিছুতেই তাদের অভাব হয়নি। কত মানুষের প্রাণ গেল? অনাহার নিপীড়িত মানুষেরা গুলি, বোমা আর বন্দুকের আঘাতে প্রাণ হারালেন! পথে প্রান্তরে মানুষহুলি পড়ে রইলেন। কত মা এর কোল খালি হল। নেতারা লাভবান হলেন। মা, স্ত্রী বা শিশু সন্তানের কান্না, চোখের জলে বিভিন্ন মাপের নেতাদের কারো মন ভিজলো না। ক্ষমতার দম্ভে এরা হত্যার পক্ষে কত যুক্তি দিলেন। হায় ছায়াবৃতা, কালো ঘোমটার নীচে কী বীভৎস রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করলাম!?
অন্যদিকে দেশের মানুষদের মধ্যে রাজনৈতিক পেশার লোকেরা মানবতা শিষ্টাচার ভদ্রতা এসব প্রায় জলাঞ্জলি দিতে বসেছেন দেশ ও সমাজ থেকে। যাদের সমর্থন নিয়ে তারা রাজ্য দখল করতে চেয়েছে, সেইসব মানুষ কিভাবে বেঁচে থাকতে পারে, কিভাবে ভালোভাবে দিনযাপন করতে পারে, কিভাবে সবার উন্নতি হয়, সেসব ব্যাপারে তাদের কোন লক্ষ্য নেই এবং অদূর অতীতেও ছিলনা। যতটুকু না করলে নয় এবং লোক-দেখানোর জন্য বা মিডিয়াতে প্রচার করার জন্য কিছু কিছু কাজ তারা করেছে এবং যেগুলিকে শতবার লক্ষগুণ বড় করে দেখানোর জন্য তাদের কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপন দিতে একটুও কুন্ঠাবোধ হয়নি।
আর একদিকে আমাদের এই চরম মহামারী যে ভয়াবহ আকার নিয়েছিল তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে করোনা মহামারীর বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রনের প্রচেষ্টাকে শিকেয় তুলে লক্ষ হাজার মানুষের সমাবেশ করেছে। যেখানে না ছিল মাস্ক, না ছিল স্যানিটাইজার না ছিল পারস্পরিক দূরত্ব। এই পরিস্থিতিতে করোনা গণভাবে ছড়িয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। যাকে বলা হচ্ছে গোষ্ঠী সংক্রমণ। পুরো দায়ীত্ব নিয়ে এই সংক্রমণ ঘটানো হয়েছে দেশের প্রধান প্রধান ব্যক্তিদের দ্বারা। এ বড়ো লজ্জার, হতাশার ও অমানবতার। এছাড়াও আছে লক্ষ লক্ষ মানুষের ধর্মীয় সমাবেশ। সরকার সব জেনেও সংক্রমন নিয়ন্ত্রনের জন্য কোন বিধি নিষেধ কড়া ভাবে প্রয়োগের বিন্দুমাত্র উদ্যোগ নেয়নি। যার জন্য দেশ রক্ষাকারীদের দায়িত্বজ্ঞান হীনতার অভিশাপ আমাদের সবাইকে বয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে। প্রাণ দিতে হচ্ছে অজস্র মানুষকে। খনার বচন ‘রাজার পাপে রাজ্য নষ্ট’।
সারাদেশে একই চিত্র আমরা লক্ষ্য করছি যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছেন। হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন পৃথিবীর সঙ্গে সম্বন্ধ ছিন্ন করে প্রয়াত হচ্ছেন। তাতে কি? যারা দেশের কর্তাব্যক্তি, তারা বেশ সুখে স্বাচ্ছন্দে আছেন। বলা যায় এই করোনা কে পুঁজি করে নিজেদের ভান্ডার কে কিভাবে পূরণ করতে হয় সে ব্যাপারেও তারা সিদ্ধহস্ত এবং তাদের বিভিন্ন তহবিল তারা আরো বেশি করে বৃদ্ধি করতে পেরেছেন ও পারছেন।
মেলা হচ্ছে। রমজান উপলক্ষে সমবেত হওয়া, রামনবমী, কুম্ভ মেলা, লক্ষ লক্ষ মানুষের উদ্দাম সমাবেশ করোনার প্রতিমূর্তি হয়ে হাজির রাষ্ট্রের কাছে। রাষ্ট্র বড়ো না ধর্ম? এই বিতর্কের মাঝে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের কৌশল যখন ধর্ম, তখন এর বিরুদ্ধে কথা বলা বা কিছু করার চেষ্টা বাতুলতা। তাই ধর্মের আফিমে কোন ভেজাল বা বাধা না দিয়ে তার নিখাদ অগ্রগতিকে করোনায় নমোঃ করতে তাদের বাধেনি। এই কী রাষ্ট্র ধর্ম? নিষ্পাপ দরিদ্র মানুষগুলি অচেতন ও দারিদ্রের কবলে মেলায় পুণ্য সঞ্চয় করতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে, আর করোনার বিষ ছড়িয়ে দেবার বাহক হয়েছে। পরিণতি হয়েছে ভয়ঙ্কর। আর সেই ভয়ঙ্কর প্রবাহে প্রাণ যায় অজস্র জ্ঞানী গুনী ও সাধারণ মানুষের। নেতা আর দেশের কর্তাব্যক্তিদের তাতে কিছু যায় আসে না। তারা বেশ ফূর্তিতেই আছেন। যা তাদের চেহারায় আর বেশভূষায় তা ধরা পড়ছে।
কত কাল রবে বল’ ভারত রে
শুধু ডাল ভাত জল পথ্য ক’রে ।
দেশে অন্নজলের হল ঘোর অনটন—
ধর’ হুইস্কি-সোডা আর মুর্গি-মটন ।
যাও ঠাকুর চৈতন-চুট্কি নিয়া—
এস’ দাড়ি নাড়ি কলিমদ্দি মিয়া ।
শিক্ষাবিদদের মধ্যে একটা বড় অংশও করোনার সময়টাকে নিজেদের সুযোগ হিসেবে ব্যাবহার করছেন। তাদেরও কোন জায়গাতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না এবং তারা যারা মাস মাইনেতে সংসার চালান, সরকারি তহবিল থেকে নিয়মিত যাদের অর্থ আসে তারা সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলিকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে নিজেদের নীরবতা বজায় রাখেন। এখন খুব জোরে বলতে ইচ্ছা করে-
এ দুর্ভাগ্য দেশ হতে হে মঙ্গলময়,
দূর করে দাও তুমি সর্ব তুচ্ছ ভয়–
লোকভয়, রাজভয়, মৃত্যুভয় আর।
দীনপ্রাণ দুর্বলের এ পাষাণভার,
এই চিরপেষণযন্ত্রণা, ধূলিতলে
এই নিত্য অবনতি, দণ্ডে পলে পলে
এই আত্ম-অবমান,অন্তরে বাহিরে
এই দাসত্বের রজ্জু, ত্রস্ত নতশিরে
সহস্রের পদপ্রান্ততলে বারম্বার
মনুষ্যমর্যাদাগর্ব চিরপরিহার–
এ বৃহৎ লজ্জারাশি চরণ-আঘাতে
চূর্ণ করি দূর করো। মঙ্গলপ্রভাতে
মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে
উদার আলোক-মাঝে উন্মুক্ত বাতাসে।
ইতিমধ্যে গত এক বছরে ভারতে এই মহামারীকে মোকাবিলার জন্য যে ধরনের পরিকাঠামো নির্মাণ এবং প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল সে সম্পর্কে সরকারী উদাসীনতা এত বেশি যা আমাদেরকে অবাক করে! সেখানে হাসপাতাল বানানো কিংবা স্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তোলার কোন প্রয়োজন অনুভব করেননি। স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য যে ভ্যাকসিন ইতিমধ্যে আমাদের দেশে হাজির হয়েছে সেগুলি সাধারণ মানুষের কাছে দ্রুত বণ্টনের জন্য এবং পরিমাণমতো তার যোগান দেওয়ার জন্য যে ব্যবস্থা সেই ব্যবস্থা কে প্রায় সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেছেন দেশের কর্তা ব্যক্তিরা। আমরা সাধারণ মানুষরা নিরুপায়! কিন্তু নির্বাচনী প্রচার আর ক্ষমতার দম্ভ পরস্পরকে গালাগালি, এগুলো এখনো চলছে এবং কেউ নিজের দোষকে খুঁজে বের করার চেষ্টা না করে অন্যদেরকে ক্রমাগত গালাগালি দেওয়ার যে প্রবণতা তা দেশের মানুষকে এবং মানবতাকে সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
একদিকে মানবতা ভূলুণ্ঠিত, অন্যদিকে দেশের সম্পদ কুক্ষিগত করার জন্য একচেটিয়া কিছু পুঁজিপতি তারা ভীষণভাবে উদ্বেল হয়ে রয়েছে এবং তারা তাদের কাজ করে চলেছে। প্রশাসন এবং দেশের কর্তা ব্যক্তিরা তাদের থেকে যথোপযুক্ত পরিমাণ দক্ষিণা স্বরূপ লক্ষ্য লক্ষ্য কোটি টাকা নিয়ে দেশ এবং দেশের সম্পদকে তাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য যারপরনাই দ্রুততার সাথে সেই সব কাজই করে চলেছেন। এ জন্য দেশের আইন শাসন ব্যবস্থা সবকিছুকেই প্রয়োজনমতো অদল বদল করতে তাদের মাথা খাটাতে হচ্ছে যথেষ্ট। তাই এই মহামারী মোকাবিলার জন্য যা যা করা দরকার ছিল, টিকাকরণের কর্মসূচি যথাযথভাবে পালন করার জন্য যে তৎপরতার প্রয়োজন ছিল সেগুলিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে তারা কুণ্ঠাবোধ করেন নি।
দেশের যারা মাথা তারা এতোটুকু এই সামাজিক মানসিক যন্ত্রণা কোন কিছুকেই আঁচ করতে পারলেন না। বড় পুঁজির ব্যবসায়ীরা তারাও এই এক বছরে তাদের লাভের পরিমাণ যথেষ্ট বাড়িয়ে নিতে পেরেছেন। যারা সরকারি মাসোহারা পেয়ে থাকেন তাদের খুব একটা অসুবিধা হয়নি। কিন্তু যারা বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন যারা দিন আনে দিন খায়, যারা দূরে অন্য রাজ্যে কাজ করে মাসে মাসে পরিবারের কাছে টাকা পাঠান, যারা লোকের বাড়িতে কাজ করে মাস গেলে দুই তিন হাজার টাকা আয় করেন, যারা ঠেলা রিক্সা চালান, যারা ছোটখাটো বিভিন্ন ধরনের কাজের সাথে যুক্ত তারা কাজ হারিয়ে ভয়ানক সমস্যার মধ্যে চলেছেন। আর সমস্যার মধ্যে পড়েছেন শিল্পীকূল। যাঁরা প্রতিদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য নিজেদেরকে অনেক সাধনা করে গড়ে তুলেছেন, তাঁরা একটু একটু করে নিজেদের সময় গুলিকে ব্যয় করেছেন নিজেদের দক্ষতা ও মেধাকে সম্পূর্ণ প্রয়োগ করে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লক্ষ্যে। তাঁরা আজ বড়ো অসহায়! ভয়ানক বিড়ম্বনার মধ্যে চলতে হচ্ছে তাদের! যারা দিন আনেন দিন খান, তাদের জন্য রেশন ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের জন্য ১০০ দিনের কাজে রয়েছে, কিন্তু এইসব নামী ও অল্প নামী শিল্পীদের জন্য কোথাও কিছু নেই। তারা না পারেন বলতে, লাইনে দাঁড়িয়েসাহায্য চাইতে, না পারেন সংসার চালাতে। তাদের যা-কিছু সহায়-সম্বল ছিল গত এক বছরে সম্পূর্ণ নিঃশেষিত হয়ে গেছে। তারা আশা করেছিলেন আস্তে আস্তে এই দুর্দশার অন্ত হবে এবং পুনরায় শিল্পীকূল হয়তো ক্রমে বেশি বেশি করে কাজ করে নিজেদের আর্থিক অবস্থা কে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গ প্রবলভাবে সারাদেশে আছড়ে পড়ায় এবং সরকারি উদাসীনতার কারণে তার ভয়াবহ আকার এদের দিশাহারা করে তুলেছে। এই অবস্থায় শিল্পীদের পাশে কে দাঁড়াবে? কে এই সব শিল্পীদের জন্য মুক্ত হস্তে দান করবে? কারা এইসব শিল্পীদের অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে? কারা এই সব শিল্পীদের অনুষ্ঠানকে মর্যাদা দেবে?
সরকারি এবং রাজনৈতিকভাবে যে সমস্যাকে বাড়িয়ে তোলা হয়েছে তার জন্য সরকার এবং রাজনৈতিক নেতাদের উচিত অন্য দুস্থ মানুষদের পাশাপাশি শিল্পীদের জন্য যথাযথভাবে মাসোহারার ব্যবস্থা করা, যাতে অন্তত তারা তাদের সংসার চালিয়ে, কোনোভাবে বেঁচে থাকতে পারেন। এছাড়াও আমরা যারা শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল আমাদেরও উচিত এসব শিল্পীদের পাশে দাঁড়ানো। সবাই যদি মাসে খুব সামান্য করেও অর্থ দিয়ে একটি তহবিল গঠন করতে পারি, তাহলে সেই তহবিল থেকে কিছু কিছু দিয়ে বেশকিছু সংসারকে সুস্থভাবে জীবনযাপন করতে সাহায্য করা যেতে পারে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যে দায়িত্ব সেই দায়িত্ব তাদের পালন করতেই হবে। আর অগ্রণী নাগরিক হিসেবে আমাদেরও বেশকিছু দায়িত্ব রয়েছে সেই দায়িত্ব আমাদের পালন করা দরকার।
আর্থিকভাবে পাশে দাঁড়ানোর জন্য শিল্পীদের কিভাবে চিহ্নিত করা হবে?
সরকারি তালিকায় যাদের নাম রয়েছে সেই সব শিল্পীদের দায়িত্ব যদি সরকার নেয় তাহলে বাকি যেসব শিল্পীরা রয়েছেন, যারা সরকারি অনুষ্ঠানের বাইরে অন্য জায়গায় অনুষ্ঠান করেন, তাদের একটি তালিকা তৈরির জন্য বেশ কিছু মানুষকে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। উপযুক্ত প্রমাণ সহ আবেদন করলে সেই আবেদন গুলি পরীক্ষা করে তা থেকে একটি সঠিক তালিকা প্রস্তুত করা যায়। যারা সরকারি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেননি কিন্তু বাইরের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠান করেছেন তাদের একটি তালিকা পৃথকভাবে প্রস্তুত করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল মানুষকে রাজ্য সরকার থেকে হোক বা সামাজিকভাবে কোন প্রতিষ্ঠান তৈরি করে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।
এই কাজগুলি করার জন্য আর বেশি দেরি করা হলে তা আমাদের চরম ক্ষতি বা হতাশার দিকে নিয়ে যেতে পারে। কাজেই আমার মত হল দ্রুততার সাথে এই কাজগুলোকে সম্পন্ন করা এবং একটি তহবিল গঠন করার জন্য সমাজের গুণী মানুষদের দিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করা। যারা এই কাজটিকে দায়িত্ব নিয়ে পরিচালনা করবেন।
এছাড়াও আমরা বড় বড় সাংস্কৃতিক বোধ সম্পন্ন গুনী মানুষকে, বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকেও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসার জন্য আহবান জানাতে পারি। যেমন আইটিসি, টাটা, বোরোলিন, বিভিন্ন তেলের কোম্পানিগুলি, খবরের কাগজের দপ্তর, বিভিন্ন মিল, শপিং মল ইত্যাদি সংস্থা।
আর একটা কাজ আমরা করতে পারি তা হল অনলাইনে অল্পদামের টিকিটে বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন। এর ফলে একটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে উঠবে। সাংস্কৃতিক চর্চা বাড়বে। বিভিন্ন শিল্পী জায়গা পাবেন। প্রচারের আলোয় আসবেন। এটা প্রতিদিন ধারাবাহিকভাবে চালালে বিজ্ঞাপনও আসতে পারে। তবে অনুষ্ঠান সর্বাঙ্গ সুন্দর করে তোলার জন্য যে ঝক্কি তা আমাদেরকেই নিতে হবে। মহৎ কাজের জন্য এভাবে আয়োজন করা যায়।
[চলবে]