September 1, 2021

গুরু আমুবী সিংয়ের নৃত্যশৈলী

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

সায়ন্তনী চৌধুরী

গুরু আমুবী সিংয়ের নৃত্যশৈলী

ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি অপূর্ব সুন্দর নৃত্যশৈলী হল মণিপুরী। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যখন প্রথম মণিপুরী নৃত্য দেখেছিলেন তখন এটি তার সমস্ত সৌন্দর্য্য, কাবধর্মিতা ও ভাবের আবেদন নিয়ে কবির চিত্তবীণায় নাড়া দিয়েছিল। মণিপুরের বাইরে নৃত্য প্রচারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পথিকৃৎ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তারপরে গুরু আমুবী সিং এটিকে মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে বের করে শুধুমাত্র শিল্পের খাতিরে মঞ্চে পরিবেশনার উপযুক্ত করে তোলায় ও মণিপুরের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় এর প্রচারে এক বিরাট পদক্ষেপ নেন। তাঁর নৃত্য রচনার কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছু বলতে চাই।

    জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’র হরিরিহমুগ্ধব’ রচনাটির উপর গুরুজীর নৃত্যরচনায় “গোপবধূরনু গায়তি….রাগম” অংশটিতে যেখানটা ঐ স্তবকটা শেষ হয়ে পরের স্তবক ‘কাপি বিলাসবিলোলবিলোচন’ শুরু হয়েছে সেখানে বসা থেকে ওঠাটা খুব শিল্পসম্মত। ওখানেই তাঞ্চেপ তালের আগের আবর্তন শেষ হয়ে পরের আবর্তন শুরু হচ্ছে, গানে পরের স্তবকটি শুরু হচ্ছে (অর্থাৎ নতুন বর্ণনা শুরু হচ্ছে) তার সঙ্গে বসা থেকে ঘুরে ঘুরে ওঠা শুরু হচ্ছে। তার ঠিক আগের আর্বতনের শেষ মাত্রায় বাঁ পা ফেলে বসা হচ্ছে। তাল, কাব্য ও movement-এর এত precise সমাপতন আমার মতে খুব সৌন্দর্য্যপূর্ণ। গুরুজীর নৃত্যচরনাগুলি দেখলে আমার ব্যক্তিগতভাবে ওনাকে খুব precise ভাবে কাজ করা ও perfectionist মানুষ বলে মনে হয়।

    আমার ধারণা শিল্পের একটি শাখার মাধ্যমে প্রকাশ করা বিষয়বস্তুকে অন্য শাখার মাধ্যমে প্রকাশ করতে হলে প্রয়োজনীয় বদল আনতে হয়। কারণ একই বিষয়বস্তু শিল্পের একটা শাখার মাধ্যমে যেভাবে প্রকাশ করলে ভাল লাগে অন্য শাখার মাধ্যমে হুবহু সেই একইভাবে প্রকাশ করলে ভাল নাও লাগতে পারে। যেমন কোনো উপন্যাস থেকে সিনেমা বানাতে গেলে উপন্যাসটিকে হুবহু অনুসরণ করলে অনেক সময় সিনেমাটা ভালমতো বানানো যায় না। কারণ সাহিত্য ও চলচ্চিত্র শিল্পের দুটি আলাদা শাখা। এটা গুরুরীর রচনাগুলিতেও দেখা যায়। যেমন ‘শ্রিতকমলা’তে “কালিয় বিষধরগঞ্জন জনরঞ্জন” এই অংশতে শ্লোকের মানে কালীয়সর্পকে দমনকারী, জনমনোরঞ্জন। গুরুজী এখানটা কাব্যের ভাষাকে হুবহু অনুসরণ করেননি। নৃত্য যেহেতু শিল্পের অন্য একটি শাখা, তাই কালিয়নাগ যে আসছে ও নর্তকী (ভক্ত) তাকে দেখে ভয় পাচ্ছে এইটুকুই দেখিয়েছেন। কারণ এর বেশী দেখালে ভাল লাগত না, হয়ত তালের মধ্যে দেখানোও যেত না।

    গুরু আমুবীর নর্তনশৈলীতে কবজি ও গলার movement ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ, সূক্ষ ও সুন্দর। দশাবতারের “ক্ষত্রিয়রুধিরময়ে” অংশে বামনের বর্ণনা শেষ হয়ে পরশুরামের বর্ণনা যেখানে শুরু হচ্ছে সেখানে তাল তাঞ্চেপ থেকে তেওড়া হচ্ছে, লয়টা দ্রুত হচ্ছে এবং হঠাৎ করে একটি বাকী শরীরসহ গলার movement এই অংশটিতে নাটকীয় করে তুলছে ও mood-টা বদলে দিচ্ছে। কারণ পরশুরামের বর্ণনায় রৌদ্ররস রয়েছে, উপরন্তু তেওড়া তালের মধ্যে একটা spirit ও আছে। এছাড়া ‘শ্রিতকমলা’তে রামের বর্ণনাতে (“অমলকমলদললোচন”) ‘লোচন’ – এর জায়গাটা কব্জি না ভেঙে চোখ দেখালে সেটা শৃঙ্গাররসপূর্ণ (erotic) হয়ে যেত বলে আমার ব্যক্তিগত ধারণা। দশাবতারে কল্কি অবতারের বর্ণনায় (“ধুমকেতুমিব”তে) ধূমকেতু দেখানোর সময়ও কব্জি  ভাঙ্গাটা আমার খুব সংযত ও রুচিসম্মত বলে মনে হয়েছে। Dance is stylized body language. গুরুজীর রচনাগুলি দেখলে এটাও বোঝা যায় যে ওনার body language – এর sense খুব ভাল ছিল। 

গুরুজী নিজে মণিপুরী নাচের সঙ্গে গানের সুরও রচনা করতেন। এ প্রসঙ্গে গুরু দেবযানী চালিহার লেখা ‘Maisnam Guru Amubi Singh’ বইটির থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি, “Guruji was a great singer, being trained in the Sankirtana tradition. Early in the morning with a shovel in hand, he would take care of the garden while humming a tune. His imaginative mind was always alert. I discovered that he composed songs while tending to the garden.” অতএব, মণিপুরী নাচের গানে ওনার নিজস্ব কিছু সংযোজন থাকতেই পারে।

    মণীপুরে তিনজন প্রধান নৃত্যগুরু ছিলেন। ওজা  মৈষ্‌নাম আমুবী সিং, ওজা আতন্বা সিং ও ওজা আমুদোন শর্মা। গুরু আমুবী সিংকে এই তিনজনের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে করা হয়। আজ কবিগুরুর গানের মাধ্যমেই তাঁর রচনা সম্পর্কে বলি, তাঁর রচিত নৃত্যগুলি দেখলে মনে হয়,

“মুগ্ধ নয়ন মম, পুলকিত মোহিত মন।।”

[বিশিষ্ট গুরু লাইসরাম মঙ্গোলজাও সিং এবং চৌবু শর্মার অধীনে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর, গুরু আমুবি সিং (ওজা আমুবি নামেও পরিচিত) মণিপুরী নৃত্যের ক্ষেত্রে তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। এমন একটি সময়ে যেখানে দেশের বাকি অংশে এই নৃত্য ধারার খুব বেশি প্রকাশ ছিল না, আমুবি সিং ইম্ফল থেকে মণিপুরী নৃত্য শেখাতে এসেছিলেন এবং উদয় শঙ্করের একাডেমির সাথে যুক্ত ছিলেন। একজন প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী ছাড়াও, তিনি অনেক রকলের সঙ্গীত ও নৃত্য চর্চা করেছেন এসব তত্ব অধ্যয়ন করেছেন। তিনি ছিলেন একজন সুপরিচিত সুরকার।

১৯৫৪ সালে যখন জেএন মণিপুর ড্যান্স একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন আমুবি সিং এর প্রথম সুপারভাইজার হন। তিনি ১৯৫৬ সালে কেন্দ্রীয় সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার এবং১৯৭০ সালে পদ্মশ্রী পান।

গুরু। মাইসনাম আমুবি সিং ছিলেন সমস্ত ম্যান ইপুরির মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাধর নৃত্য গুরু যারা নৃত্য সিংয়ের মণি-পুরি শৈলীর সৃজনশীল বিবর্তনে একটি নতুন অভিযোজন দিয়েছেন। তাঁর সৃজনশীল প্রতিভা ভক্তের প্রতি তাঁর বিশ্বাসের সাথে মিলিত হয়েছিল। তাঁর কাছে নৃত্য ছিল নিছক বিনোদন নয় বরং একটি বিরল সাধনা। এটা ঈশ্বর উপলব্ধি করার একটি উপায় ছিল। তিনি সাহসী উদ্ভাবনশীলতা দিয়ে এর শিল্পের ঐশ্বর্য পুনঃআবিষ্কার করেছিলেন। তার নতুন রচনা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুধুমাত্র মণিপুরের শৈল্পিক ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেনি বরং ভারতীয় নৃত্যের সমসাময়িক আন্দোলনকেও গতি দিয়েছে।]

সায়ন্তনী চৌধুরী

Mobile No. : 8697053872

E-mail ID : scpritea@gmail.com প্রাক্তনী, রবীন্দ্রভারতী, নৃত্য বিভাগ

তথ্যসূত্র

১।http://snarepository.nvli.in/bitstream/123456789/3271/1/JSNA%2868%2939-41.pdf

২। https://bn.wikipedia.org/wiki/গুরুবিপিনসিংহ

৩।https://lokogandhar.com/শান্তিনিকেতনের-নৃত্য-ধার/

৪।https://sunitidebnath.blogspot.com/2018/06/blog-post.html