The Old Lady-বুড়িটা

Dr. Jayanti Mandal

Abstract: This narrative unfolds the life of an elderly woman who has spent her years begging, occasionally finding work to sustain herself. Referred to simply as the “old woman,” her daughter, Ramavati, is married off to an unfamiliar young man named Dharramdas. Dharramdas, seeking financial stability, relocates Ramavati to a distant place to earn rent. However, when Ramavati refuses to comply, Dharramdas resorts to locking her away without sustenance. The old woman, despite her challenges, endeavours to rescue her daughter from this dire situation, portraying a poignant story of survival against the harsh realities of poverty and degradation.

বুড়িটা

জয়ন্তী মন্ডল

বুধনী যখন রেশন নিয়ে ঘরে ফিরল তখন সন্ধে গড়িয়ে অন্ধকার। বুধনী উঠোনের চাতালে পা দিয়ে দ্যাখে দুয়ারে কে যেন বসে আছে। বুধনীর ঠাওর হল না। কাছে গিয়ে শুধোল কে বটে?

সনাতন উঠে দাঁড়াল। বলল, এত দেরি যে? রেশনে খুব লাইন ছিল?

বুধনী মাথা থেকে গমের বোঁচকাখানা নামিয়ে হাঁপ ছেড়ে বলল, হারান মন্ডল ছিল নি। টাউন গেছিল। এল দেরিতে। 

সনাতন দা তুমি কি মনে করে?

আমি টাউন গেছিলুম। শম্ভু লায়েকের সঙ্গে দেখা হল। শম্ভু বলল, ও চাতরা গেছিল।

চাতরার নাম শুনেই বুধনীর বুকটা ধক করে উঠল। চাতরা!

বুধনী শুকনো মুখ নিয়ে বলল, বেটিটা আমার ভালো আছে তো সনাতনদা?

সনাতন বলল, তোর বেটির কথা বলছিল শম্ভু।

বুধনী উদগ্রীব হয়ে বলল, শম্ভূ কী বলছিল দাদা?

মেয়েটার একবার খোঁজ খবর করা দরকার সে কথায় বলছিল শম্ভূ। চাতরার বাজারে ধর্মদাসের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

বুধনী তাড়াতাড়ি বলল, বেটিটার কথা কিছু বলল?

না।

বুধনী কালো মুখ করে বলল, বছর দুই হল। বেটিটার কিছু খবর পাই নি। বুকের ভেতরটা বড় আকুলি বিকুলি করে বেটিটার জন্যে।

নিজের মনেই বিড় বিড় করে বলল, কেন যে বেটিটাকে ধর্মদাসের হাতে দিলুম।

কিন্তু সব কি ওর ইচ্ছে মতো হয়! সে বছর পাড়ার মরদেরা এসে বলল, বুধনী বেটির বিয়ে দিবি?

বুধনী বলেছিল, রমা আমার এই সবে বারো তে পা দিইচে। আর ক’টা বছর বেটিটা ঘরে থাক।

গণেশ ভাঙ্গি বলল তোর ঘরে মরদ নাই। জামাই যখন ঘর বয়ে আসছি তাকে ফেরাস নি।

গণেশ ভাঙ্গির কথায় যেন আদেশের স্বর।

পাড়ার মরদেরা সকলে গণেশ ভাঙ্গির কথায় সায় দিল।

বুধনী কোনো উত্তর করেনি। চুপ চাপ উঠে গিয়েছিল ঘরের ভেতর।

পরদিন ধর্মদাস সকাল বেলায় এসে বুধনীর বেটি রমাবতীকে বিয়ে করে নিয়ে চলে গেল চাতরা।

সঙ্গে বুধনীর দাদা মঙ্গল গিয়েছিল। কদিন পর মঙ্গল ফিরে এলে বুধনী মঙ্গলকে শুধোলো আমার রমার ঘর কেমন দেখলে দাদা?

মঙ্গল কাঁধের গামছা খানা একবার ঝেড়ে নিয়ে বলল, জামাই এর ঘর বিরাট দালান কোঠা। তবে ঘরে লোক জন কাউকে দেখতে পেলুম নি।

কথাগুলো মনে পড়তেই আকুল হয়ে বুধনী জিজ্ঞেস করল, আমার রমার কোনো অসুখ করেনি তো সনাতনদা?  ভালো আছে তো বেটি আমার?

সনাতন বলল, অনেকদিন তো হল। বেটির একবার খোঁজ নিয়ে আসা ভালো। লোকে নানা কথা কয়।

বুধনী  দাওয়ায় সনাতনের সামনে বসল। বলল, কদিনই বেটিটার জন্যে বড্ড মনটা বড় খারাপ গো দাদা। জামাই টা যে…বলে ডুকরে কেঁদে উঠল বুধনী।

সনাতন বলল, ভয় পাস না বুধনী। গাঁয়ের লোক আছে। তেমন বুঝলে আমরা গাঁ থেকে লোকজন নিয়ে যাবো। তখন দেখি জামাই কি করে।

বুধনী নিজের মনেই বলল গাঁয়ের লোক যদি হক কথা বলত তবে তো আর আমার বুকের ধনকে এমন করে ভিন দেশে পাঠিয়ে দিতে হত নি।

সন্ধে গড়াতেই সনাতন চলে গেল।

সেদিন রাতে বুধনী বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধুই কাঁদল। সারারাত চোখের পাতা বন্ধ করতে পারল না। কী জানি বেটিটা কেমন আছে! শম্ভু আমার রমার খোঁজ করল ক্যানে? তবে কি রমা আমার ভালো নাই?

দুবছর আগে জামাই এর সঙ্গে চাতরা যাবার সময় রমা বলে গেছিল,

মা, এবার বড়াম পুজোয় মামাকে পাঠাবি তো? বড়াম পুজোয় পাড়ার সব ঝিউড়িরা এসবে। কত আনন্দ হবে। আমাকেও আনবি। মামাকে পাঠাবি তো মা?  মা!

বুধনী ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসল। না আর একটুও দেরি করলে চলবে নি। সকালেই গণেশ ভাঙ্গির কাছে যেতে হবে।

তখনও আকাশ ফর্সা হয়নি গণেশের ঘরের দরজায় ধাক্কা। গণেশ ঘুম জড়ানো চোখে দরোজা খুলে বুধনীকে দেখে বলল,

কি হল? এত ভোর ভোর তোর আবার কি দরকার পড়ল?

বুধনী মুখখানা কাচু মাচু মুখ করে বলল,

একবার বেটিটাকে দেখতে যেতুম।

তুওর বেটিকে দেখতে যেতে আমি বারণ করেছি? এই সকাল বেলায় আমার কাছে চলে এলি ক্যানে?

বুধনী মাথার উস্কো খুস্কো চুলে একবার আঙ্গুল বুলিয়ে নিয়ে করুণ মুখে বলল,

কটা টাকা পেলে বেটিটার কাছে একবার যেতুম বাপ।

গণেশ ভাঙ্গি ঝাঁজ নিয়ে বলল, টাকা! এই সকাল বেলায় টাকা? আমি কি টাকার গাছ লিয়ে বসে আছি। যার যখন দরকার হবে আর আমি গাছ থেকে টাকা পেড়ে দুবো।

বুধনী আর কান্না রাখতে পারল না। হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। তারপর কাপড়ের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে বলল,

সর্দার পাড়ার শম্ভু চাতরা গেছিল ।

গণেশ ভাঙ্গি চোখ দুটো কপালে তুলে ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, কেউ চাতরা গেল মানে তুওর বেটি খারাপ আছে? এখন  আমার সময় নাই। বাড়ি যা।

বুধনী চুপ করে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলল, আমায় টেরেনের ভাড়াটা দে না বাপ! সামনের চাষে খেটে আমি শোধ দিয়ে দুবো।

এবার গণেশ ভাঙ্গি রণমূর্তি ধরে গর্জে বলল,

সকাল বেলায় মেলা বক বক করিস নি। এখনই এখান থেকে বিদেয় হ। দশটায় পঞ্চায়েত যেতে হবে। আজ আবার বলক থেকে অফিসার বাবু এসবে। এসব বাজে কথা শুনার সময়  নাই আমার।

বুধনী আর নিজেকে সামলাতে পারল না। মরিয়া হয়ে গণেশ ভাঙ্গির পা দুটো ঝপ করে জড়িয়ে ধরে  বলল দে না বাপ কটা টাকা। আমি খেটে তোর সব টাকা শোধ করে দুবো। বাপ মরা বেটিটা যে বড্ড বিপদে আছে!

গণেশ ভাঙ্গি তাড়াতাড়ি পা দুটো হেঁচকে সরিয়ে নিয়ে বলল, তোর বেটি যদি খারাপ থাকে আমি কি করবো। গাঁয়ে কি আরো লোক নাই। টাকার দরকার পড়লে তোদের কি শুধু আমার কথায় মনে পড়ে?  

তারপর একটা হাঁক দিলো … মনসা!

অমনি কালো মিসমিশে একটা জোয়ান মরদ এসে বুধনীর  সামনে দাঁড়িয়ে বলল, চল ঠাকমা। এখানে মেলা বকবক করিস নি। কিছু লাভ হবে নি।

বুধনী উঠে দাঁড়িয়ে কঠিন মুখে মনসা কে উদ্দেশ্য করে বলল, থাক গায়ে হাত লাগাস নি। তারপর বুধনী চুপ চাপ বেরিয়ে এল গনেশ ভাঙ্গির  উঠোন থেকে।

বুধনী পায়ে পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়ালো নিজের উঠোনটায়।

আর দেরি করল না বুধনী। বোঁচকাতে একটা কাপড় আর কৌটৌয় কটা মুড়ি ছিল সেগুলো বেঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো বেলাবেলি।

সারাদিন হেঁটে বুধনী যখন স্টেশনে পৌঁছলো তখন সন্ধ্যে নেমে গেছে। স্টেশনের কলের জলে মুখ ধুয়ে বোঁচকা থেকে একটা টিনের থালা বের করল। টিনের থালাটায় খুঁটে বাঁধা মুড়ি গুলো ঢেলে স্টেশনের কলের জলে মুড়ি কটা ভিজিয়ে এক নিমেষে সেগুলো শেষ করে খানিক পেটপুরে কলের জল খেয়ে নিল সে।

এরপর টিনের ভাঙ্গা থালাটা হাতে ধরে বাড়িয়ে বসলো স্টেশনে লোক আসা যাওয়ার পথে।

রাত বেশী হওয়ার আগেই কিছু পয়সা আর গোটা কতক কাগজের নোট থালায় জমতেই স্টেশনে কালো কোট পরা একটা লোকের সঙ্গে কথা বলল বুধনী। গভীর রাতে একটা মেল ট্রেন ঢুকতেই কালো কোট পরা লোকটার ইসারায় ট্রেনে উঠে পড়ল সে।

ট্রেনের এক কোণে বসে বসে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল বুধনী। ঘুম ভাঙ্গল পেটের খিদেয়।

স্টেশনের ভিক্ষের পয়সায় একটা রুটি কিনেছিল। রুটিটা খেয়ে ট্রেনে বাথরুমের পাশের কলে পেট ভরে জল খেয়ে বাথরুমের দরোজার পাশে এসে বসল। একটু ঢুলুনি আসতে এক কোণে কাপড়ের খুঁট খানা বিছিয়ে শুয়ে পড়ল বুধনী।

টানা একরাত একদিন ট্রেন চলার পর ট্রেন এসে থামল মোগল সরায় স্টেশনে। তখন চারদিক ফর্সা।

বেটির বিয়ের বছর খানেক পর মঙ্গলের সঙ্গে বুধনী একবারই চাতরা এসেছিল। টাকা কড়ি কিছুই দিতে পারেনি রমাবতীকে। কোনরকমে একটা জর্জেটের কাপড় কিনে পরিয়ে পাঠিয়েছিল বেটিকে। তাই, বুধনী বাড়ি ফেরার সময় রমাবতীর কান্না দেখে জামাই বলেছিল,

বুড়িটা ঘর যাচ্ছে তো অত কাঁদিস ক্যানে। বুড়ি কি চিতেয় যাচ্ছে?

বুধনি আর দাঁড়ায়নি। আরো কিছুক্ষণ দাঁড়ালে বেটিটাকে জামাই এর কাছে আরো মুখ ঝামট খেতে হবে।

সেও তো কবছর পার হয়ে গেল। তারপর আর একটিবারের জন্যেও  রমাবতীকে পাঠায়নি ধর্মদাস।

পাড়ার নবাকে দিয়ে চিঠি লিখিয়ে কত চিঠি পাঠাল। কোনো উত্তর আসেনি। বাপ মরা বেটিটাকে সে লেখাপড়া শেখাতেও পারেনি।

কত দুঃখের দিন গেছে তখন। এখনই বা কম কী!

বাবুর মেয়ের পুজোর সওদা দিয়ে ফেরার সময় বুধনীর মরদটাকে লোধাশুলির জঙ্গলে কারা যেন মেরে ফেলেছিল। খবরটা পেয়েছিল একদিন পর। পুলিশ আসার আগেই ওখানকার লোকেরা বেওয়ারিশ লাশ বলে পুড়িয়ে দিয়েছিল ।

তখন ছোট্ট রমাবতী ইস্কুলে যেত। মরদটা এমন করে চলে যাবার পর বুধনী আর ইস্কুলে পাঠাতে পারেনি বেটিকে।

 ছোট্ট রমাকে কাপড়ে বেঁধে পিঠে ঝুলিয়ে এ গাঁ ও গাঁয়ে ভিক্ষে করতে চলে যেত বুধনী। বাবুদের ঘরে দাঁড়ালেই রমা মায়ের কাপড়ের বোঁচকা থেকে একটা বাটি বের করে বলত একটু ভাত দেবে গো বাবু।

এতটুকু মেয়ের কথায় কোনো গেরস্থ বাটিটায় দুটো পান্তা ফেলে দিত। কোনো গেরস্থ দূর দূর করে তাড়িয়েও দিত।

ইস্কুলে রমাবতীর ‘কর’ ‘খল’ এর বেশি এগোয়নি। মায়ের চিঠি সে পড়বে কেমন করে? জামাইয়ের হাতে চিঠি পড়ে। জামাই রমাকে চিঠির খবর দেয়না।

 সে ও তো দু বছর ঘুরে গেল। সনাতন ক্যানে বলল, রমার কথা।

সনাতনের কথা গুলো  মনে পড়তেই বুকটা কেমন করে উঠল বুধনীর। তাড়াতাড়ি পা চালাল সে।

একবার বেটিটাকে দেখে প্রাণ জুড়োবে সে। ‘বেটিটাকে গিয়ে দেখতে পাবো তো?’ ভেবেই বুকের ভেতরটা কেমন শিরশিরিয়ে উঠল বুধনীর।

অনেকবছর আগের রাস্তা, ঘর বাড়ি সব কেমন পাল্টে গেছে। জামাই এর ঘরখানা চিনতে পারল না বুধনী। অনেক খোঁজা খুঁজির পর যদি বা জামাইয়ের ঘর খুঁজে পেল দ্যাখে জামাইয়ের ঘরের দরোজায় তালা দেওয়া।

জামাই এর দরোজায় তালা দেখে বুধনীর বুক তোলপাড় করে উঠল। আপন মনেই বলল, বেটিটা আমার বেঁচে আছে তো!

বুধনী শুনেছে ভিনদেশের অসাধু লোক গাঁ থেকে মেয়েদের বিয়ে করে এনে বেচে দেয়।

তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে ভাবল বেটি হয়তো জামাই এর সঙ্গে কোথায় গেছে। আমি মিছামিছি ভাবছি।

জামাই এর ঘরের দরোজার সামনে বসে পড়ল বুধনী। সকালবেলা এদিক ওদিক মানুষের যাতায়াত শুরু হয়ে গেছে। তারা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে।

কয়েকজন মহিলা কণ্ঠ বুধনীর কাছে এসে থেমে গেল।

বুধনীকে ধর্মদাসের দরোজায় বসে থাকতে দেখে একজন বয়স্ক বুড়ি জিজ্ঞেস করল কাকে খুঁজছো?

বুধনী উঠে দাঁড়াল। বলল, ধর্মদাস আমার জামাই। ওরা কোথা গেছে তোমরা বলতে পারো?

বুড়িটি কপালে ভাঁজ নিয়ে বলল, সে তো আমরা বলতে পারব না। তবে দিন দশেক আগে ধর্মদাসকে একবার দেখেছিলাম। সঙ্গে কয়েকজন লোক ওর দাওয়ায় বসেছিল।

একজন যুবতী এগিয়ে এসে বলল, ধর্মদাসের বউকে আমি দেখেছি। সেদিন আমি ধর্মদাসের কাছে তাবিজ নিতে এসেছিলাম।

বুড়ি বুধনীকে বলল, ধর্মদাস কোথাও গেলে এত সকাল ফিরবে না। তুমি বরং একটু বেলা পর্যন্ত অপেক্ষা কর।

বুধনী বলল, আমার বেটিকে যতক্ষণ না পাবো ততক্ষণ আমি এখানেই অপেক্ষা করব।

মেয়েদের দল বুধনীকে কিছু বুঝিয়ে চলে গেল। বুধনী ধর্মদাস এর দরোজায় বসে থাকতে থাকতে ট্রেনের ক্লান্তিতে দরোজায় হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

ঘুম ভাঙ্গল আবার সেই বুড়িটির ডাকে।

বুড়ি বলল আমি সতু খুড়ি। সকালে এসেছিলাম আমায় চিনতে পারছ?

বুধনী বলল, হ্যাঁ মা চিনতে পারছি।

জিজ্ঞেস করল, এখনো ধর্মদাস আসেনি? তুমি সেই থেকে বসে?

বুধনী বলল, না। জামাই, বেটি কেউ এসেনি। এখন আমি কি করব? তাই তো ভাবছি!

সতু বুড়ি বলল, সন্ধ্যে পার হয়ে গেল। এখানে বসে থেকে কি করবে। তার চেয়ে বরং আমাদের সঙ্গে আমাদের বাড়ি চলো।

বুধনী অবাক হয়ে সতু বুড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাদের বাড়ি? তবে তো ঢের উপকার হয় মা। বলে হাত জোড় করে সতু বুড়িকে প্রণাম জানালো।

সতু বুড়ি বলল, তাছাড়া আর উপায়ই বা কি! কত দূর থেকে এসেছো। যাবেই বা কোথায়?

বসে বসে ভেবে ভেবে সারা হয়ে গিয়েছিল বুধনী। ধর্মদাস যদি না ফেরে তবে সে কোথায় যাবে!

সতু বুড়ির বাড়ি বলতে উঁচু বস্তিতে একচালা একটা দরমার ঘর। ঘর থেকে বের হলেই বস্তিরই সরু গলি। গলিতে সার দিয়ে বিশ বাইশ খানা বস্তির বসতি।

সতু বুড়িও একা থাকে। রাতের খাবার বুধনীকে দিয়ে দুজনে ভাগ করে খেল। রাতে সতু বুড়ির কাছে খেলেও দিনেরবেলা প্রায় না খেয়েই কাটল তার।

দুদিন এমন চলার পর সতু বুড়ি বলল, দেখো এই ভাবে আর কতদিন বসে থাকবে। তারচেয়ে বরং আমাদের সঙ্গে কাজে চলো। তাতে তোমার পেট ভরবে আর হাতে দুটো পয়সাও আসবে। আর এর মধ্যে ধর্মদাস নিশ্চয় এসে পড়বে।

সতু বুড়ি বলল, কিছু মনে করো না বাছা। ধর্মদাস মানুষ ভালো নয়। কেন মেয়েকে ওর হাতে দিলে?

বুধনী বলল, আমরা কি জানতুম ওর কথা। গাঁয়ের লোক ধরল তাই বেটিটাকে বলতে বলতে কেঁদে উঠল বুধনী।

সতু বুড়ি বলল, কেঁদে কি হবে? নিজেকে শক্ত করো।

পরদিন বুধনী, সতু বুড়ি আর পাড়ার আরো যুবতী মেয়েদের সঙ্গে কাজে বের হল।

একটা কারখানায় বস্তা পাট করার কাজ। বুধনী ওদের সঙ্গে কদিন কাজ করে কটা পয়সা হাতে পেতে বুকে বল পেল। যাক এবার খাওয়ার চিন্তা কিছুটা হলেও কমল। ভাবল এবার বেটিটার হাতেও কিছু টাকা দিয়ে যেতে পারব।

কিন্তু মনটা যে শুধুই হু হু করে ওঠে। কেবলই ভাবে বেটিটা কোথায় গেল! ধর্মদাস বেটিটাকে কোথায় নিয়ে গেল!

সেদিন কারখানায় কাজ করার সময় গৌরি বলে বউটি বলল ও একদিন তাবিজ আনতে ধর্মদাসের বাড়ি গিয়েছিল। ধর্মদাস ছিল না। ওর বউ ছিল। গৌরিকে দেখে ধর্মদাসের বউ ঘর বন্ধ করে চুপি চুপি বলল, আমি এখান থেকে পালাতে চায়। আমার স্বামী আমাকে বাড়ির বাইরে বের হতে দিচ্ছে না।

গৌরি জিজ্ঞেস করেছিল পালাতে চাও কেন?

ধর্মদাসের বউ বলল প্রতিদিন আমার স্বামী ঘরে কতগুলো করে লোক আনে। ভাবলুম তাবিজ কবচ আনতে এসছে ওরা। লোকগুলোর সঙ্গে আমাকে একটা ঘরে বসিয়ে টাকা পয়সার কথা বলে। প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি। কদিন পর একজন লোক আমার স্বামীকে অনেক টাকা দিল। তারপর আমার স্বামী আমাকে বলল কাপড় চোপড় গোছগাছ কর।

জিজ্ঞেস করতে বলল, দেবরাজ এর সঙ্গে তোকে যেতে হবে।

আমি কিছুতেই যেতে রাজি হলুম নি। বললুম আমাকে মায়ের কাছে দিয়ে এসবে চল।

দেবরাজ বলে লোকটা আর আমার স্বামী চোখ পাকিয়ে বলল, না গেলে তোকে এখানে মরতে হবে। সেই রাতেই আমি কাপড় চোপড় গুছিয়ে নিয়েছি। খুব ভোর বেলা উঠে বেরিয়ে পড়েছিলুম। কোনদিকে স্টেশন ঠিক পথ চিনি নি। একাই আলো আঁধারে পা চালিয়ে যাচ্ছি। কিছুটা যাওয়ার পরই দেখি আমার স্বামী আমার সামনে দাঁড়িয়ে।

আমাকে বলল, ঘরে চল আমি তোকে তোর মায়ের কাছে দিয়ে আসব। আজ কদিন হয়ে গেল দিতে গেল নি। বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল বউটা সেদিন।

গৌরির মুখ থেকে কথা গুলো শোনার পর থেকে বুধনীর বুকের ভেতরটা উথাল পাতাল করতে লাগল। তবে কোথায় গেল বেটিটা! ভেবে ভেবে কূলকিনারা করতে পারল না বুধনী।

কারখানা থেকে ফেরার পথে প্রতিদিনের মতো সেদিনও বুধনী ধর্মদাসের দরোজায় এসে বসল। তবে আজ বুধনীর চোখে মুখে একটা আতঙ্ক! সন্ধের অন্ধকার গাঢ় হলে উঁচু বস্তিতে ফিরে গেল সে। ফিরে গিয়ে নিজের জন্যে  দুটো রুটি তৈরি করে চিনির জলে ভিজিয়ে রুটি দুটো খেল। বিছানায় শুয়ে বুধনী সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারল না। 

পরদিন কারখানায় বস্তা পাট করতে করতে বুধনীর শুকনো মুখখানা দেখে সতু বুড়ি বলল, এমন করে ভেবে ভেবে শরীর কাহিল কোরো না বুড়ি। তার চেয়ে তুমি বরং কাল একবার থানায় যাও। সেখানে সব বল। পুলিশ কিছু করলেও করতে পারে।

সতু বুড়ির কথাটা একেবারে যে মনে ধরেনি তা নয়। ভাবল কাল কারখানায় যাবার পথে আগে সে থানায় যাবে।

পরদিন বুধনী কারখানার পথে থানায় গেল। থানাটা সতু বুড়িই দেখিয়ে দিয়েছিল বুধনীকে।

থানার পুলিশ বুধনীর কথাগুলো শুনতে শুনতে খাতায় অনেক কিছু লিখে নিল।

বুধনী থানার পুলিশ অফিসারটিকে বলল, আমার বেটিকে খুঁজে দিবে তো বাবু।

থানার পুলিশটি ঘাড় নেড়ে বলল, আপনি এখন বাড়ি যান। খোঁজ পেলে জানিয়ে দেবো।

থানার বড়বাবুর কথা শুনে বুধনী শুকনো মুখে থানা থেকে বেরিয়ে এল। কিন্তু মনে যেন কোনো ভরসা পেল না।

প্রতিদিনের মতো সেদিনও বুধনী কারখানা থেকে ফেরার পথে সন্ধেবেলা ধর্মদাসের দরোজায় এসে বসল। অনেকক্ষণ বসে আছে ভেতর থেকে একটা কিসের আওয়াজ যেন কানে এল বুধনীর। বুধনী কান খাড়া করে শব্দটা শোনার চেষ্টা করলো।

কিন্তু না! আর কোথাও কোন  শব্দ পাওয়া গেল না।

বুঝল মনের ভুল। উঁচু বস্তির পথে পা বাড়ালো সে। কিন্তু বুধনীর মন যে এখান থেকে  কিছুতেই যেতে চাইছে না।  ছাতিটা হাহাকার করে উঠছে বেটিটার জন্যে। কিছুটা গিয়ে আবার ফিরে এল সে।

ধর্মদাসের দরোজায় গিয়ে আবার খানিকক্ষণ বসে রইল ক্ষ্যাপার মতো। পথের পাশে চৌকাঠটায় বসে দরোজায় কান পাতল সে। আওয়াজটা শোনার চেষ্টা করল।

কিছুক্ষণ কান পেতে শোনার পর একটা গোঙানির মত শব্দ তার কানে এল। বুধনী বুঝতে পারল আওয়াজটা ধর্মদাসের ঘরের ভেতর থেকেই আসছে। 

বুধনী হন্ত দন্ত হয়ে ছুটে গিয়ে উঁচু বস্তির কটা ছেলেকে ডেকে ব্যাপারটা বলল।

কাহার পাড়ার ছেলের দলের একটা ছেলে কেরামের গুটিকে লক্ষ্য করে স্ট্রাইকার থেকে চোখ না তুলে  বুধনীর মুখ থেকে সব কথা শুনে বলল, ধর্মদাস মাঝে মাঝে এ গাঁয়ে ও গাঁয়ে ভূত ছাড়াতে যায়। ওইসব প্রেতাত্মাদের বাড়িতে এনে তুকতাক করে বশ করে রাখে। তাই ধর্মদাসের বাড়ির পাশ দিয়ে গেলে আমরাও মাঝে মাঝে ওরকম একটু-আধটু আওয়াজ পাই। ওসব মানুষের আওয়াজ না। তুমি ভিন দেশের মানুষ ধর্মদাসের ব্যাপার  স্যাপার বুঝবে না।

ছেলেগুলোর কথাই বুধনীর বুকের ভেতরটা তীব্র প্রতিবাদ করে বলতে চাইল তোমরা একটিবার চলো। দরোজার তালাটা খুলে দিবে চলো। কিন্তু বুধনী এই বিদেশ বিভুঁইয়ে এসে একটু যে থাকার জায়গা পেয়েছে সেই ঢের। এর উপর বেশি আবদার করতে পারল না ওদের।

বুধনী ছেলেগুলোর মুখের দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে কি একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে শুকনো মুখে উঁচু বস্তিতে সতু বুড়ির দরমার ঘরে ফিরে এলো।

কোনরকমে বুড়ির উনুনে দুটো রুটি তৈরি করে চিনির জলে ডুবিয়ে রুটি দুটো খেয়ে সতু বুড়ির কাঁথায় শুয়ে শুয়ে বুধনী আকাশ পাতাল ভাবতে লাগল।

কি জানি আমার বেটিটা কোথায় গেল? বাড়ির ভেতরে নেই তো? ধর্মদাস বেটিটাকে বাইরে থেকে তালা দিয়ে যায়নি তো?

কথাটা ভেবেই ধড়ফড় করে বিছানা থেকে উঠে বসল বুধনী। কাউকে কোন কথা না বলে রাতের অন্ধকারে হাঁটা দিল ধর্মদাস এর ঘরের দিকে।

ধর্মদাসের ঘরের কাছে পৌঁছে ধর্মদাসের ঘরের চারদিকটা আবছা অন্ধকারে ঘুরে ঘুরে কি খোঁজার চেষ্টা করল বুধনী। তারপর একই রকম ভাবে বসে পড়ল দরোজার সামনে।

কিছুক্ষণ এভাবে বসে থাকার পর আবার সেই আওয়াজটা কানে এল বুধনীর। তবে আওয়াজটা আগের থেকে কম। দরোজায় ভালো করে কান দিয়ে শুনল বুধনী। আওয়াজটা মাঝে মাঝে নানা রকম শব্দে হচ্ছে। কখনো খিনখিনে গলায়। কখনো একটা গোঙানীর মতো।

বুধনী নিজের গাঁয়ে অনেকবার ওঝার ঝাড়ফুঁক দেখেছে। কিন্তু কখনো প্রেতাত্মাদের চোখেও দেখেনি। আর তাদের কোনো আওয়াজও শোনেনি।

আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল না বুধনী। অন্ধকারে হনহন করে ফিরে এল উঁচু বস্তিতে। সতু বুড়ির ঘরের কোণে পড়ে থাকা শাবল খানা নিয়ে হাঁটা দিল ধর্মদাসের ঘরের দিকে।

ধর্মদাসের দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে বুধনীর চোয়াল শক্ত হল। চোখ মুখে তীব্র ক্রোধ। কাপড়ের আঁচলটা কোমরে শক্ত করে বাঁধল সে। তারপর অন্ধকারেই শাবলটা দিয়ে ধর্মদাসের উঠোনের দরোজার পাশের দেওয়ালটা কাটার চেষ্টা করল। কিচ্ছুক্ষণ শাবল চালানোর পর দেওয়ালের মাটিটায় কিছুটা গর্ত হয়ে দেওয়াল থেকে মাটির চাঙড় ভেঙ্গে পড়ল। বুধনীর মাথা থেকে সারা শরীর ধূলোয় মাখামাখি। এবার গর্তটা দিয়ে বুধনী ধর্মদাসের উঠোনে ঢুকে পড়ল ।

উঠোনে পা দিয়েই শব্দটা আরো আরও স্পষ্ট শুনতে পেল বুধনী।

কি করবে! কেমন করে দালানের ভেতর ঢুকবে  ভেবে পাগলের মতো গোটা উঠোনময় হাঁচড় পাঁচড় করে ছোটাছুটি করতে থাকল সে। কিন্তু কোন দিক থেকে যে আওয়াজটা আসছে! কিছুতেই ঠিক বুঝে উঠতে না পেরে চিৎকার করে কেঁদে উঠল বুধনী। রমাবতী….!  ….. রমাবতী!

আবার চিৎকার করে ডাকল, রমাবতী…। রমাবতী মা আমার!

কোথায় রমাবতী! বুধনীর চিৎকারে ঘরের ভেতর থেকে শুধু কতগুলো পাখি সশব্দে উড়ে গেল। পাখি উড়ে যাওয়ার আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শোনা গেল না।

বুধনী আর অপেক্ষা করল না। হাতের শাবলটা দিয়ে দালানের দরোজায় সজোরে ঘা মারল।

শাবলের ঘায়ে দালানের দরোজাটা ঝনঝনিয়ে উঠল ঠিকই কিন্তু দরোজা যেমন কার তেমনি দাঁড়িয়ে রইল।

এবার বুধনী মরিয়া হয়ে শাবল চালালো দরোজার পাশের দেওয়ালের মাটিটায়। শাবলের কয়েকটা কোপ মারতেই দরোজার পাশের মাটি ঝর ঝর করে ভেঙ্গে পড়ল মেঝেতে।

বুধনীর শরীরে এখন আসুরিক শক্তি।

এরপর সে শাবলের ঘা মেরে মেরে দরজার একপাশের মাটি ফাঁকা করে দিয়ে শাবলটা নিয়ে গলে গেল ফাঁকটা দিয়ে।

লম্বা বারান্দাটায় পা দিয়েই বুধনী আবার চিৎকার করে ডাকল রমাবতী….!

রমাবতী মা আমার….!

না। কোত্থাও কোনো সাড়া নেই। আবার সেই নিঝুম নিশ্চুপ। উঠোনের চাঁদের আবছা আলোয় ঘরের দরজা খোলা দেখে বারান্দা থেকে ছুটে গেল ঘরের ভেতর। ঘরের ভেতর পা ফেলে মাটির দিকে তাকিয়ে বুধনীর বুকটা একেবারে হাহাকার করে উঠল।

কঙ্কাল!

শেষে কিনা এই ছিল রমার ভাগ্যে। চিত্কার করে বুক চাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুধনী লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে কঙ্কালটার পাশে।

কেঁদে কেঁদে কতক্ষণ যে জ্ঞান হারিয়েছিল নিজেই জানে না।

জ্ঞান ফিরলো একটা গোঙানীর শব্দে। কঙ্কালটার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে আওয়াজটা শোনার চেষ্টা করল।

কিন্তু না! কঙ্কালটায় যে প্রাণ নেই তা বুঝতে দেরি হল না তার।

কিন্তু আবার একটা গোঙানীর আওয়াজে কঙ্কালটা ফেলে উঠে দাঁড়াল সে।

দাঁড়িয়ে টের পেল গোঙ্গানীর শব্দটা ওপর থেকে আসছে ।

বুধনী কোনরকমে অবশ্ পা দুটো নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল দোতলার ঘরে। কোথা থেকে শব্দটা আসছে শোনার জন্য বুধনী কান পেতে দাঁড়াল।

গোঙ্গানীর শব্দ এখন আরো স্পষ্ট!

দ্রুত পা চালালো সে।

দোতলায় উঠে কয়েক পা এগিয়ে প্রথম ঘরটাই ঢুকে আবছায়া অন্ধকারে বুঝল ঘরটার ভিতর উঁচু করে কিছু জিনিষপত্র রাখা আছে। বুধনী প্রায় শুয়ে পড়ে অন্ধকারে জিনিষপত্র গুলো হাতড়াতে লাগল। কিন্তু কতগুলো মাটির ভাঙ্গা পাত্র আর গাছের ডাল ছাড়া কিছুই হাতে লাগল না তার।

এমন সময় খিনখিনে গলায় চিঁ চিঁ শব্দটা আবার কানে আসতেই বুধনী ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটে গেল দোতলার পাশের ঘরের দিকে।

দোতলার শেষের ঘরে পা ফেলেই প্রায় আঁতকে উঠল বুধনী। একটা কঙ্কালসার দেহ পড়ে রয়েছে মেঝেতে।

বুধনী তড়িৎ গতিতে এগিয়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল দেহটার উপর।

কঙ্কালসার শরীরটাকে ছুঁয়ে  বুধনীর মনে হল দেহটাতে এখনো প্রাণ আছে!চিঁ চিঁ শব্দটা যে দেহটা থেকেই আসছে এতক্ষণে নিশ্চিত হল সে।

এক লহমায় কঙ্কালসার দেহটাকে কোলে তুলে ছুটে নেমে এল দোতলা থেকে। দেহটাকে দাওয়ায় কোল থেকে নামিয়ে মাটিতে রেখে  আকাশে ওঠা একফালি চাঁদের আলোয় মুখখানা স্পষ্ট না হলেও চিনতে অসুবিধে হল না রমাবতীকে।

তারপর একছুটে উঠোনের কুয়োর কাছে গেল। কিন্তু কুয়োয় যে জল তুলবে কুয়োর আশে পাশে কোনো দড়ি, বালতি, কলসি নেই দেখে সায়া টুকু নিজের শরীরে রেখে শরীর থেকে কাপড়টা খুলে কাপড়ের খুঁটটা ধরে বাকি কাপড়টা কুয়োর জলে ফেলে দিল।

কুয়ো থেকে ভেজা কাপড়টা তুলে এনে দেহটার মুখে ভেজা কাপড় থেকে জল নিংড়িয়ে দিতে লাগল। কিছুক্ষণ এরকম করে জল দেওয়ার পর বুধনী কঙ্কালসার দেহটার মুখের চোয়ালের দাঁতগুলো ফাঁক করে হাত দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করল বেটিটার মুখে জল যাচ্ছে কিনা না। তবে বুধনীর কাপড়ের নিংড়ে দেওয়া জলে কঙ্কালসার দেহটায় জলে জব জব করতে লাগলে দেহটা একটু নড়ে উঠল মনে হল।

বুধনীর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। কিছুতেই মরতে দেবে না সে বেটিকে।

এরপর রমার কঙ্কালসার শরীরটাকে কোলে তুলে নিয়ে বুধনী সিঁড়ি বেয়ে তড়িৎ গতিতে নেমে এল ধর্মদাসের দাওয়ায়। দাওয়া থেকে ছুটে উঠোন পেরিয়ে দেওয়ালের গর্ত ভেঙ্গে হিঁচড়ে বেরিয়ে ছুটে চলল উঁচু বস্তির দিকে।

উঁচু বস্তিতে বুধনী যখন রমার প্রায় মৃত শরীরটা নিয়ে এসে ফেলল তখন উঁচু বস্তির ছেলে বুড়ো মিলে প্রায় সবাই  ঝুঁকে পড়ল তার উপর।

এক্ষুনি হাসপাতাল নিয়ে যেতে হবে। কেউ ছুটেছে সাইকেল ভ্যান ডাকতে। কেউ ছুটেছে গরম দুধ আনতে।

পাড়ার ছেলে বুড়ো সকলে চিৎকার করে বলতে লাগল প্রাণ আছে!  এখনো শরীরে প্রাণ আছে!

বুধনী বেটির মুখের উপর মুখ দিয়ে বেটিকে জড়িয়ে রয়েছে। নিজের বুক দিয়ে অনুভব করছে বেটির শ্বাস প্রশ্বাসের ধুকপুকানি।

উঁচু বস্তির ছেলেরা হাসপাতাল নিয়ে যেতে বেশি দেরি করেনি।

হাসপাতালে ডাক্তারবাবু দেখে বললেন, এখনো আশা আছে।

আজ একমাস হাসপাতালের দরোজায় বসে আছে বুধনী। বুধনীর পাশে বস্তায় মোড়া কি যেন একটা।

হঠাৎ একদিন ধর্মদাস হাসপাতালে এসে হাজির। বুধনী কোনো কথা বাড়ায়নি। চুপচাপ পাশে রাখা বস্তার ভেতর থেকে শাবলখানা বের করে ধর্মদাস এর দিকে আগাতেই ধর্মদাস দৌড় দিল পিছন পানে।

বুধনী তার আসুরিক শক্তি দিয়ে ধর্মদাসকে ধরতে পারত। কিন্তু বেশিদূর আগায় নি সে।   

সাগরের মতো একবুক আশা নিয়ে হাসপাতালে বসে আছে বুধনী। ডাক্তার বাবু বলেছেন তোমার মেয়ের আর কোনো ভয় নেই। মেয়েকে নিয়ে তবে সে নিজের গাঁয়ে ফিরবে ।