সঙ্গীতের প্রভাব মনে – অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

How Classical Music Engages with Indian Mythology: Storytelling through Ragas

আমি আলোচনা করব মনের উপর সঙ্গীতের প্রভাব সম্পর্কে।  সংগীত আমাদের মনের অন্তর্গত অনুভূতিগুলোকে জাগিয়ে তোলে । কোমল সুর মনকে শান্ত করে, আর জোস পূর্ণ তাল দেয় উচ্ছ্বাস। কিন্তু সঙ্গীতের প্রভাব এর চেয়েও অনেক বেশি।আমাদের মন যখন চঞ্চল থাকে তখন সংগীত আমাদের মনকে একাগ্র করতে সাহায্য করে। রাগ বা সুরের ধারা অনুসরণ করতে গিয়ে মন অন্য চিন্তা থেকে সরে এসে সঙ্গীতে মগ্ন হয়। এই একাগ্রতা আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও কাজে লাগে, যেখানে মনোযোগের অত্যন্ত প্রয়োজন। এছাড়া সংগীত আমাদের মনের চাপ কমাতে সাহায্য করে। যেমন আমরা উদ্বিগ্ন বা হতাশায় থাকি তখন সুমধুর সংগীত শ্রবণ মনকে লাঘব করে তোলে। এমনকি গান গাওয়ার সময় বা বাজানোর সময় শিল্পীর মনকে আনন্দিত করে এবং মনের ভার কমায়।

এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংগীত ভাব প্রবন্ধের কয়েকটি কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ‘আমাদের মনোভাব গাঢ়তম তীব্রতম রূপে প্রকাশ করিবার উপায়স্বরূপে সংংগীতের স্বাভাবিক উৎপত্তি। যে উপায়ে ভাব সর্বোৎকৃষ্টরূপে প্রকাশ করি, সেই উপায়েই আমরা ভাব সর্বোৎকৃষ্টরূপে অন্যের মনে নিবিষ্ট করিয়া দিতে পারি। অতএব সংগীত নিজের উত্তেজনা প্রকাশের উপায় ও পরকে উত্তেজিত করিবার উপায়’।[১]এই প্রসঙ্গে রাগ রাগিনি মূর্তি কল্পনার পিছনে বৈজ্ঞানিক ধারাই থাকে প্রবল। ভাব ও রস তাতে প্রধান ভূমিকার অংশগ্রহণ করে। নাট্যশাস্ত্রকার ভরত,এই ভাব ও রসের সম্বন্ধে একটি সম্বন্ধের পরিচয় দিয়েছেন। তবে রস আবার ভাবের চেয়ে বড়ো। রসের রূপ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে ভরত বলেছেন, আস্বাদ্য ও আস্বাদন অনুভূতিই রস। রসের শ্রেণিবিভাগ করে ভরত বলেছেন, শৃঙ্গার হাস্য, করুণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস ও অদ্ভূত এই আটটি  রস মন ও অনুভূতির সংঘাতে সৃষ্টি হয়। সর্বানন্দ চৌধুরী তার প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘যেটা ভাবতে গেলে প্রথমে মনে আসছে সংগীত নিয়ে হার্বার্ট স্পেনসর এর মত এবং তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কথাগুলো। যেখানে রবীন্দ্রনাথ বুঝতে চাইছেন আমাদের দৈনন্দিন কথাবার্তার মধ্যে সুর কিভাবে লাগে এবং স্পেনসরের মতোই বুঝতে পারছেন আমাদের মানসিক উত্তেজনা কমা বাড়ার সঙ্গে আমাদের শরীরে পরিবর্তন ঘটে। তারপরে আমাদের স্বরযন্ত্র বদলায় ও কথা সুরে ওঠানামা হয়। অর্থাৎ একটা শারীরিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আমাদের আবেগ উত্তেজনা আমাদের কথার সুরে প্রকাশ পায়। সেদিক থেকে সুরও শারীরিক অভিব্যক্তিরই একটা অংশ। আমরা যখন কথা বলি, তখন কণ্ঠস্বর সুর সঞ্চালন, হাতের ভঙ্গি, মুখমণ্ডলের পেশির কাঠিন্য কোমলতা, এরকম নানা কিছু এক করে নিজেদের আবেগকে প্রকাশ করি। গোটাটাই এক ধরনের শারীরিক প্রক্রিয়া’।[২]

এই প্রসঙ্গে সংগীত সম্রাট তানসেনের জীবনের একটা ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। সম্রাট আকবরের সভা গায়ক তানসেন সম্রাটের একান্ত প্রিয় পাত্র। তার গান ছাড়া আর কারো গানে সম্রাট সন্তুষ্ট হন না। তানসেনের এই সৌভাগ্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে তারই চারপাশের কিছু মানুষ, কিছু ওস্তাদ তার জীবননাশের চক্রান্ত করলেন। তারা জানতেন, তানসেন দীপক রাগ গাইলে সেই রাগের তেজে শেষ হয়ে যাবেন। সেই মতো তারা তানসেনকে দিয়ে দীপক গাওয়ানোর জন্য সম্রাটকে অনুরোধ করলেন। সম্রাট চক্রান্তটা ধরতে না পেরে তানসেনের আপত্তি সত্ত্বেও তাকে দীপক রাগ গাইতে বললেন।  তানসেন এই ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে দীপক গাওয়ার প্রস্তুতির জন্য সম্রাটের থেকে ১৫ দিন সময় নিলেন। আর সেই সময়ে কন্যা সরস্বতী ও স্বামী হরিদাস যিনি তানসেনেরও গুরু তার শিষ্য রূপবতীকে মেঘ রাগ শিক্ষা দিলেন। নির্দিষ্ট দিনে সভা প্রাঙ্গনে সম্রাটের উপস্থিতিতে দীপক রাগের যজ্ঞ শুরু হল। বেলা দ্বিপ্রহরে তানসেন দীপক গাইছেন কিছুক্ষণ গাওয়ার পরেই তার শরীর ঘর্মাক্ত ও চোখ দুটো রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছে সভার সকলে দারুন গ্রীষ্মের আবির্ভাব এবং গাত্রদাহ অনুভব করছেন। কিন্তু তারপরেও যখন তানসেন গাইছেন সুরের প্রভাবে সভায় রাখা প্রদীপগুলো জ্বলে উঠল এবং মুহূর্তের মধ্যে গোটা সভায় দাউদাউ করে আগুন লেগে গেল। যিনি যেদিকে পারলেন প্রাণ নিয়ে পালালেন। তানসেন অর্ধ্দগ্ধ অবস্থায় ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরে এলেন। যেখানে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মেঘ রাগের প্রভাবে আকাশ কালো করে বৃষ্টি নেমে এলো। বৃষ্টির জলে তানসেনের শরীর শীতল হল। তিনি রক্ষা পেলেন।[৩]

এই ঘটনা যে নিছক কাকতালীয় নয় তার প্রমান হিসেবে আমি আমার গুরু বাবা আলী আকবর খান সাহেবের জীবনের একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। উনি ওর আত্মজীবনী আপনাদের সেবায় লিখেছেন, ‘ছোটবেলায় বাবা যখন রাগ রাগিনী শেখাতেন তখন উনি ওদের মেজাজ চরিত্র শক্তি এসবের কথা বলতেন তখন অল্প বয়স ছিল তাই ওসব কথায় অত গুরুত্ব দিতাম না। বাবা আমাকে দীপক রাগ শেখাবার সময় তানসেনের দীপক রাগ গেয়ে প্রদীপ জ্বালাবার গল্প বলেছিলেন বাবা আমাকে ওর খাতা থেকে দীপক রাগ ও তার কিছু বন্দিশ শিখে নিতে বলেছিলেন কিন্তু কোনদিন গান গেয়ে বা যন্ত্রে শেখাননি কারণ বাবা বলেছিলেন যে ওই রাগ যেন আমি কোনদিন না গায় বাজায় কারণ গাইলে বাজালে আমার ক্ষতি হবে। আমি তখন ওসব কথায় কান না দিয়ে একদিন ঠিক করলাম দেখি না রাগটা একবার বাজিয়ে কিছু হয় কিনা। তাই আমাদের বাড়ির পিছনে যে মাঠ ছিল সেখানে গিয়ে খানিকক্ষণ বাজিয়েছি হঠাৎ কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসে গেল এবং সেই জ্বর মারাত্মক হয়েছিল। আমি প্রায় দু-তিন দিন অচৈতন্যের মতো পড়েছিলাম। বাবা শুনে খুব বকেছিলেন তখনই বুঝেছিলাম রাগ রাগিনীর ক্ষমতা। তারপর থেকে আমি কোনদিন রাগ রাগিনী নিয়ে ওইভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিনি’।[৪]

আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে মল্লার বলে একটি রাগ আছে।  সেটি সাধারণত বর্ষার সময় গাওয়া বা বাজানো হয়। তানসেন এই রাগটির সঙ্গে কানাড়া রাগ যোগ করে মিঞা কী মল্লার নামে একটি রাগ তেরি করেন। তানসেন এই রাগটি গাইলে বৃষ্টি হত। এটা যে সত্য তার প্রমান হিসাবে আমি জানাতে চাই যে, ১৯৮৮ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতার সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমির একটি অনুষ্ঠানে আমার গুরুবাবা মিঞা কী মল্লার বাজিয়েছিলেন এবং ঐ শীতকালেই বৃষ্টি হয়েছিল। আমার ক্ষেত্রেও এ ঘটনা ঘটেছিল দু’বার। একবার ১৯৯২ সালে ভূপালে এবং অন্যটি ২০১৫ সালে প্যারিসে। দু’বারই ঐ রাগ বাজাবার পর বৃষ্টি নেমেছিল। রবীন্দ্রনাথ এক প্রবন্ধে লিখেছেন, সংগীতের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের মনের কতই না ভাব প্রকাশ করি যার প্রভাব শ্রোতাদেরও ওপরও প্রভাবিত হয়। এই প্রসঙ্গে সরোদের কিংবদন্তি শিল্পী বাবা আলাউদ্দিন খান সাহেবের কথা উল্লেখ করা হল। তিনি তাঁর তার আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘আমার কথা’য় বলেছেন, ‘ভারতের সংগীত সম্বন্ধে প্যারিসের লোকেদের খুব উৎসাহ। আমাদের সংগীত যে খুব সূক্ষ্ম প্রাণ স্পন্দন জাগিয়ে তোলে তা ওরা বুঝতে পারতো। একদিন হোটেলে কয়েকটি আমেরিকান আর ইউরোপিয়ান যুবতী এলো। ভাবলাম, এখন ওদের মহলে ওরিয়েন্টাল মিউজিক টাই ফ্যাশান। তাই বোধ হয় একটু গল্প করার মত শুনে যেতে এসেছে। তখন বিকেল তিনটে। বিরক্তির সঙ্গে ধরলাম ভীমপলাশ্রী। আরম্ভের সঙ্গেই দেখলাম, না এরাতো সেরকম মেয়ে নয়। খুব মন দিয়ে শুনছে, সুরের ভিতর ঢুকতে চাইছে। বড় ভালো লাগলো। তিন ঘন্টা বাজালাম। ছ’টার সময় চেয়ে দেখি ওরা এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে রয়েছে আর চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে। কান্না আর থামে না গলা বন্ধ।…………… সংগীতের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের মত কত ভাব প্রকাশ করি ভাষার দরকার হয় না। তারের এই ঝংকারেই ভাব প্রকাশ করতে পারি, সবাই তা বুঝতে পারেন। এসব কথা তাদেরকে সরোদ বাজিয়ে বাজিয়ে বোঝাতাম। একদিন বুধাপেস্টে একদল সংগীতগুনী বল্লেন, সরোদ বাজিয়ে আমার বক্তব্য বোঝাতে। তখন বিকেল পাঁচটা, আর তিন ঘন্টা পরে সন্ধ্যে হবে। ধরলাম ভৈরবী। সবাই চোখ বুজে মন দিয়ে শুনল। বাজানো শেষ করে বললাম কি বুঝলে একজন বলল মনে হল গির্জায় বসে প্রেয়ার করছি। আর একজন বলল মনে হল, ভোরবেলা একলা বসে ভগবানের উপাসনা করছি। একের পর এক ভোরবেলা থেকে শেষ রাত্রি পর্যন্ত নানার সময়ের নানা রাগ রাগিনি আলাপ শোনালাম। আমাদের সংগীতে প্রহরের নানা ভাব যে বোঝানো যায় এ কথা সবাই স্বীকার করল। ভীমপলশ্রীকে একজন বল্ল, এ সুরে বড় কান্না আসে। তোমাদের সঙ্গীতে এত করুণ সুর কি করে সম্ভব হয় এত কান্না আসে কেন’?[৫] এবার আসা যাক আমাদের মূল বক্তব্যে যেটা বেশ কিছুটায় তাত্ত্বিক শোনাবে কিন্তু কিছু করার নেই কারণ বিষয়টাই তাত্ত্বিক।

মস্তিষ্কের অর্থ ও মানুষের মস্তিষ্কের কেন্দ্র
মানুষের স্নায়ুতন্ত্র অত্যন্ত জটিল অঙ্গ। মানুষের মস্তিষ্ক বিভিন্ন অংশে বিভক্ত। সেরিবিয়াল, সেরিব্রাম এবং হেমিস্ফিয়ারে বিভক্ত। শারীরতত্ত্ববিদরা প্রচলিতভাবে প্রতিটি হেমিস্ফিয়ার (hemisphere) কে চারটি লোবে বিভক্ত করেন। যেগুলো হল Frontal Lobes (ফ্রন্টাল লোব), Parietal Lobes (প্যারিটল লোব), Occipital Lobes (অক্সিপিটাল লোব) এবং Temporal Lobes (টেম্পোরাল লোব)। ফ্রন্টাল লোব. মস্তিষ্কের সামনের দিকে থাকে। স্বতপ্রণোদিত, স্বেচ্ছাকৃত ঐচ্ছিক ইত্যাদি জ্ঞান ভিত্তিক। এটি প্রধানত কার্যনির্বাহী ফাংশন, বুদ্ধি, ভাষা, এবং স্বেচ্ছাসেবী কার্যকলাপের জন্য দায়ী। এটি পরিকল্পনা, বিচার, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, মনোযোগ এবং বাধা সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে সহায়তা করে। ফ্রন্টাল লোবএর ক্ষতির ফলে ব্যক্তিত্ব, আবেগ, এবং আচরণে পরিবর্তন হতে পারে। ফ্রন্টাল লোব পরিকল্পনা সংগঠন ইত্যাদি করতে সাহায্য করে।

How do our brains work? | Dementia Australia

অক্সিপিটাল লোব মাথার খুলির একেবারে নিচে ও পেছনের দিকে অবস্থিত। এটি মস্তিষ্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা চোখ থেকে প্রাপ্ত সংকেত গ্রহণ ও প্রক্রিয়াকরণের জন্য দায়ী। মস্তিষ্কের চারটি প্রধান লোবের মধ্যে এটি সবচেয়ে ছোট, তবে দৃষ্টিশক্তি সংক্রান্ত কাজে এর গুরুত্ব অপরিসীম। অক্সিপিটাল লোব মূলত রঙ, আকৃতি, স্থান ইত্যাদির উপলব্ধি প্রক্রিয়াজাত করতে সহায়তা করে।

টেম্পোরাল লোব হল সেরিব্রাল কর্টেক্সের চারটি প্রধান লোবের একটি, যা মস্তিষ্কের পাশে, কানের ঠিক পিছনে অবস্থান করে। এটি স্মৃতি, ভাষা, আবেগ, শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির কিছু দিক এবং বস্তুর স্বীকৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মস্তিষ্কের উভয় পাশে অবস্থিত এই লোব আবেগ সংক্রান্ত তথ্য প্রক্রিয়াকরণ, স্মৃতিকে স্মরণে আনা এবং ভাষা বোঝার কাজে সহায়তা করে।

মনের অর্থ
মন কে মানুষের চেতনা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয় যা মস্তিষ্কে উদ্ভূত হয় এবং চিন্তা করা হয়। বিশেষত প্যাশান বা অনুরাগ। আবেগ ইচ্ছা যা স্মৃতিতে উদ্ভাসিত হয়। কল্পনার সমষ্টি গত সচেতন এবং অবচেতন প্রক্রিয়া জাতীয় সংবেদনশীল জীব যা মানসিক এবং শারীরিক আচরণকে নির্দেশ করে এবং প্রভাবিত করে।

মানুষের ওপর সংগীতের প্রভাব
সমাজের সঙ্গে সংগীতের একটা আন্ত সম্পর্ক আছে। যা সারা ইতিহাস জুড়ে দেখা যায়। সংগীত মানুষের সব কর্মের মধ্যে অন্যতম। সাধারণভাবে সংগীতের প্রতিক্রিয়া মানুষকে উভয় ভালো এবং খারাপ উপায়ে প্রভাবিত করে। এই প্রভাব গুলি তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘস্থায়ী। সংগীতকে মনে করা হয় যে বিশ্বের আবেগগত আধ্যাত্মিক এবং শারীরিক পদার্থের সঙ্গে যুক্ত। যার ফলে সঙ্গীতে একজন ব্যক্তির মেজাজ পরিবর্তন করতে সক্ষম। এবং সেই ভাবে সংগীতকে ব্যবহার ও করা যেতে পারে।
সঙ্গীত এবং মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বার্থের মধ্যে অন্তর সম্পর্ক নিয়ে বহু কাল ধরে গবেষণা করা হচ্ছে। গবেষণায় বলা হয়েছে যে সংগীত মানুষের মন ও মস্তিষ্কে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে । সংগীত কিছু রোগ নিরাময় করার ক্ষমতা রাখে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের সবচেয়ে শক্তিশালী নিরাময় ক্ষমতা পাওয়া গেছে। উদ্বেগের সাথে লড়াই করার বিষয়টিই হোক নিরাময় প্রক্রিয়াকে গতিশীল করার বিষয়েই হোক সঙ্গীত হলো সমস্ত প্রশ্নের উত্তর।
সংগীতের অর্থ
জিন মলিনোর যিনি একজন পৃথিবী বিখ্যাত সংকেত তত্ত্ববিদ বলেছেন, সংগীত একটি শিল্প বা বিনোদন এটি একটি সম্পূর্ণ সামাজিক সত্য যার সংজ্ঞা যুগ এবং সংস্কৃতি অনুসারে পরিবর্তিত হয় নির্দেশমূলক না হয়ে উপস্থাপনা মূলক। সংগীতের সাধারণ উপাদান গুলি হল পিচ যা সুর এবং সুরকে নিয়ন্ত্রণ করে তাল অর্থাৎ লয় ও গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে।

সাউন্ড বা শব্দ
পদার্থবিজ্ঞানের শব্দ হলো একটি কম্পন যা একটি প্রেস অন বা ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে যেমন গ্যাস তরল বা কঠিন মাধ্যমে একটি শব্দ তরঙ্গ হিসাবে প্রচার করে মানব দেহতত্ত্ব এবং মনোবিজ্ঞানে শব্দ হলো এই ধরনের তরঙ্গের গ্রহণ এবং মস্তিষ্ক দ্বারা তাদের উপলব্ধি।
শব্দ শ্রোতাদের মধ্যে শক্তিশালী এবং উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়া তৈরি করার ক্ষমতা রাখে এটি একটি জোরে সাইরেন যা আপনাকে জাগিয়ে তুলছে বা একটি আরামদায়ক সুর আপনাকে ঘুমাতে দিচ্ছে শব্দ নেতিবাচক ইতিবাচক বা নিরপেক্ষ প্রতিক্রিয়া ও প্রকাশ করতে পারে কেননা শব্দ আমাদের মস্তিষ্কে শক্তিশালী প্রভাব ফেলে।

স্বর
সূক্ষ্ম শব্দ বাইরে প্রকাশ পেলেই তা স্বর। মতঙ্গ মুনী বলেছেন, রাগ হলো ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি মূল উপাদান, যা স্বরের বিন্যাসের মাধ্যমে গঠিত হয়। “রাগ জনকা ধ্বনি: স্বর ইতি” এর অর্থ হলো রাগ সঙ্গীতের ভিত্তি বা উৎস হলো স্বর এবং এই স্বরগুলো নির্দিষ্টভাবে বিন্যাসিত হয়, যা রাগটিকে তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেয়। স্বরের সঙ্গে শ্রুতির সম্বন্ধ আছে। কান দিয়ে যে সূক্ষ্ম শব্দ বা ধ্বনি শোনা যায় তাকে শ্রুতি বলে।

একই সাথে অনেক লোকের প্রতিক্রিয়া থেকে জানা গেছে যে সংগীতের ও শক্তিশালী এবং দুর্বল করার ক্ষমতা আছে। সংগীতের অভিজ্ঞতা একজন দক্ষ সংগীতশিল্পী একজন অদক্ষ সঙ্গীত শিল্পী বা সাধারণ শ্রোতার সংগীত শোনার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন উপায়ে অনুভব করে। সংগীতের প্রতিক্রিয়া দেখার সময় ছন্দ অধ্যয়ন করা সংগীতের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। সন্দেশ দুটি প্রতিক্রিয়া আছে এই প্রতিক্রিয়াগুলি আলাদা করা কঠিন কারণ তারা সম্পর্কিত একটি অন্যটি ছাড়া থাকতে পারে না এই প্রতিক্রিয়াগুলো হলো সন্দেহ প্রকৃত শ্রবণ এবং ছন্দের শারীরিক প্রতিক্রিয়া। সন্দীপ আয়োজন শারীরিক নড়াচড়া যা মানব দেহের সাথে অনেক বেশি সম্পর্কযুক্ত। যা মানুষের শরীরে সহজেই শনাক্ত করা সহজ। এই সময় সংগীতের তরঙ্গ যাকে পরিভাষায় ইলেক্ট্রোএন্ট্রার্ন্সের ফেলোগ্রাম বলে তার ফলে শ্বাসের হার প্রসারিত করে। রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন বাড়ায়।

স্মৃতি এবং শেখার উপর সঙ্গীতের প্রভাব বা শক্তি

স্মৃতিকে প্রভাবিত করার জন্যে সঙ্গীতের শক্তি বেশ চমকপ্রদ। একই সাথে বাম এবং ডান মস্তিস্কের ক্রিয়া শেখার এবং তথ্যধারণ কে সর্বাধিক করে তোলে। অধ্যয়ন করা তথ্য বাম মাস্তষ্ককে সক্রিয় করে যখন সঙ্গীত ডান মস্তিষ্ককে সক্রিয় করে। এছাড়াও ক্রিয়া-কলাপ যা একই সময় মস্তিষ্কের উভয় দিককে নিযুক্ত করে। যেমন একটি যন্ত্র বাজানো বা গান করা মস্তিষ্ককে তথ্য প্রক্রিয়াকরণে আরো সক্ষম করে তোলে। অধ্যয়নের সময় সংগীত কিছু লোকের জন্য মনোযোগ এবং একাগ্রতা উন্নত করতে পারে কিন্তু অন্যদের জন্য এটি বিক্ষিপ্ত হতে পারে এবং শেখার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে সংগীতের গতি এবং তীব্রতার ও প্রভাব থাকতে পারে অধ্যয়ন ও মনোনিবেশ করার সময় গান শোনা প্রতিটি ব্যক্তি কে একইভাবে প্রভাবিত করতে পারেনা এবং গতি সব মানুষকে অধ্যয়নে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু একইভাবে নাও করতে পারে। ব্যক্তিগত পছন্দ ও গুরুত্বপূর্ণ এবং কিছু ব্যক্তি নির্দিষ্ট অধ্যয়নের পরিবেশ অন্যদের তুলনায় বেশি বলে মনে করতে পারে।

সাম্প্রতিককালে সংগীত ও মন নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে এই গবেষণাগুলো নিউরো এস্থেটিকস এর অন্তর্ভুক্ত। যার ভেতর সঙ্গীত এক জরুরী আলোচনার বিষয়। সংগীতের প্রভাব প্রাচীনকাল থেকে অনুভব করা গেছে যেমন, Greco Roman থেকে Lear, Pythagoras সঙ্গীত থেকে অঙ্কের সমাধান করেছিলেন।The Life of Pythagoras: Esoteric Classics : Porphyry: Amazon.in: Books সংগীতের প্রভাব আমাদের জীবনে বিভিন্নভাবে ও দিকে পড়েছে যেমন সামাজিক অনুভূতি এবং আধ্যাত্মিক জীবনের প্রভাব আমরা যদি বলি সংগীতের প্রভাব শরীরের উপর তাহলে আমাদের শরীরের ভেগাস স্নায়ু যা আমাদের হৃদস্পন্দনকে শিথিল করে। উত্তেজনা কমায় মনকে শান্ত করে। সামাজিক ক্ষেত্রে মিউজিক্যালিটি, মিউজিকাল গ্রুপস মানুষকে একত্র করি যেটা প্রাচীনকাল থেকে ছিল যেটা ঢাক বাজানো স্তব করা, গুণগুন করা সংগীত রচনা করা প্রাচীনকাল থেকে আগুনের ধারে বসে মানুষ এসব করতেন।Roman music hi-res stock photography and images - Alamy
সংগীতের প্রভাব শারীরিক ও আধ্যাত্মিকভাবে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমরা পেয়ে থাকি শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের জীবন থেকে। যেমন কথামৃতকার লিখেছেন, “এমন সময় গঙ্গাবক্ষে অনেক দূরে মাঝি নৌকা লইয়া যাইতেছে ও গান ধরিয়াছে। সেই গীতধ্বনি, মধুর অনাহতধ্বনির ন্যায় অনন্ত আকাশের ভিতর দিয়া গঙ্গার প্রশস্ত বক্ষ যেন স্পর্শ করিয়া ঠাকুরের কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল। ঠাকুর অমনি ভাবাবিষ্ট। সমস্ত শরীর কণ্টকিত। মাস্টারের হাত ধরিয়া বলিতেছেন, “দেখ দেখ আমার রোমাঞ্চ হচ্ছে। আমার গায়ে হাত দিয়ে দেখ!” তিনি সেই প্রেমাবিষ্ট কণ্টকিত দেহ স্পর্শ করিয়া অবাক্‌ হইয়া রহিলেন। “পুলকে পূরিত অঙ্গ”! উপনিষদে কথা আছে যে, তিনি বিশ্বে আকাশে ‘ওতপ্রোত’ হয়ে আছেন। তিনিই কি শব্দরূপে শ্রীরামকৃষ্ণকে স্পর্শ করিতেছেন? এই কি শব্দ ব্রহ্ম?[৬]
কথামৃততে ঈশ্বরের আনন্দ শুধু গানের মধ্য দিয়ে নয় বাদ্য ও নৃত্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ লীলা প্রসঙ্গ থেকে জানা যায় কাশিতে তিনি বীণা বাদন ও শুনেছিলেন।

শ্রী বৃন্দাবনে অবস্থানকালে ঠাকুরের বীণা শুনতে ইচ্ছা হইয়াছিল কিন্তু সে সময়ের তথায় কোন বীণকার উপস্থিত না থাকায় উহা সফল হয় নাই। কাশীতে ফিরিয়া তাঁহার মনে পুনরায় ওই ইচ্ছা উদয় হয় এবং শ্রীযুক্ত মহেশচন্দ্র সরকার নামক একজন অভিজ্ঞ বীণকারের ভবনে হৃদয়ের সহিত উপস্থিত হইয়া তিনি তাহাকে বীণা শোনাবার জন্য অনুরোধ করেন। মহেশ বাবু কাশীস্থ মদনপুরা নামক পল্লীতে অবস্থান করিতেন। ঠাকুরের অনুরোধে তিনি সেদিন পরম আহ্লাদে অনেকক্ষণ পর্যন্ত বীণা বাজাইয়া ছিলেন। বীণা সুমধুর ঝংকার শুনিবার মাত্র ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়াছিলেন। পরে অর্ধ বাহ্যদশা উপস্থিত হইলে তাহাকে শ্রীশ্রী জগদম্বার নিকটে ‘মা, আমায় হুঁস দাও, আমি ভালো করিয়া বীণা শুনিব’—এইরূপ প্রার্থনা করিতে দেখিলাম।[৭] এই রূপে প্রার্থনা করিতে শোনা গিয়েছিল।S W A R O O P R O Y | Another illustration done for Vedanta Kesari magazine by Ramakrishna Math Chennai . It can be seen in January 2022 issue. Sri Ramakrishna... | Instagram
কমলকৃষ্ণ মিত্র সংকলিত শ্রীরামকৃষ্ণের প্রিয় সঙ্গীত ও সঙ্গীতে সমাধি গ্রন্থে রামপ্রসাদ সেনের “তোদের ক্ষ্যাপার হাট বাজার” গানটির সঙ্গে শ্রী রামকৃষ্ণের নৃত্যের অপূর্ব বর্ণনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। গ্রন্থে রামলাল চট্টোপাধ্যায় কমলকৃষ্ণকে বলেন, ‘”ঠাকুর রামপ্রসাদের এই গানটি বিশেষভাবে টানটুন দিয়ে রকমারি করে গাইতেন ও নাচতেন। রামলাল দাদার নাচের বর্ণনা দেন: বাঁ হাতটি অর্ধেক উঁচু করে, ডান হাতটি থেকে একটু তফাতে রেখে, ডান পায়ের হাঁটু মুচকিয়ে মুচকিয়ে ডান পাটি থপ থপ করে ফেলিয়ে, কোমর ব্যাঁকিয়ে ব্যাঁকিয়ে নাচতে লাগেন। চোখে মুখে কী যে ভাব, যেন একেবারে উলুস্থানের কালী এসে পড়েছেন।” [৮] এই আলোচনা থেকে কিছু প্রশ্ন ও পর্যবেক্ষণ উঠে আসে যেমন,

• এটা অসম্ভব যে সংগীতের মনের উপর কোন প্রভাব নেই। আবার এটাও সত্য যে সংগীতের সাথে পরিচিতি, মনে কি ধরনের প্রভাব ঘটবে তা নির্ধারণ করবে।

• রাগ সংগীত কিছু লোকের মনকে শান্ত করতে পারে যারা এটি সম্পর্কে কিছুই জানেন না।

• কিন্তু রাগ সংগীত তাদের মনকে বিরক্ত ও বিচলিত করতে পারে যারা তার চর্চা করে না।

• রাগ সঙ্গীত জাপানি এবং চীনা সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

• উভয় ক্ষেত্রেই সংগীত মনকে প্রভাবিত করে একটি ইতিবাচক এবং অন্যটি নেতিবাচক।
• এটি নির্ভর করে মনের প্রকৃতি সংগীতের ধরন এবং এটি কিভাবে সঞ্চারিত হয় এবং তাদের দ্বারা এবং কোন প্রেক্ষাপটে সংগীতটি অনুভব করা হয় তার উপর।
• মিউজিক, সাইকোলজি এন্ড মিউজিক থেরাপি উভয়ই মনের উপর সঙ্গীতের মোকাবিলা করেছে।

• উভয়ই সম্পর্ক অন্বেষণ করার জন্য একটি আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি গ্রহণ করে। তাদের উভয়ের তা করার জন্য আলাদা লক্ষ্য এবং ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে।

• সব সংস্কৃতির অন্তর্গত শ্রোতাদের মনে বিভিন্ন সংস্কৃতি সংগীত বিবেচনা করার সময় তারা সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হন।

• চীনা শাস্ত্রীয় সংগীত সেই সমস্ত মনকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে যারা এটি বোঝে কিন্তু বিরূপভাবে সেই মনকে প্রবাহিত করে যারা এটা বোঝেনা।
• সৈনদের বীরত্ব বাড়ানোর জন্য যুদ্ধ সংগীত ব্যবহার করা হয়েছে এবং বন্দিদের নির্যাতন করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে যখন একটি একক গান বা বাজনা কয়েকদিন ধরে ক্রমাগত তার সামনে পরিবেশন করে।

• কিন্তু মনের উপর সঙ্গীতের প্রভাব দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বজুড়ে আদিবাসী ও ঐতিহ্যবাহী সমাজের স্বীকৃত হয়েছে ।

• সংগীত বা মন উভয়কে অপরিহার্য করা অসম্ভব কারণ উভয়েরই অসীম প্রকার রয়েছে এবং উভয়ের মধ্যে যেকোনো সংযোগ খুবই জটিল এবং গভীর যা একটি সাধারণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে কমিয়ে আনা যায়।

• তাই মনের উপর সঙ্গীতের প্রভাবের প্রশ্নটি কিছু দৃষ্টান্ত এবং প্রসঙ্গে গভীর হতে পারে এবং অন্যদের ক্ষেত্রে বেশি এবং অতিমাত্রায় হতে পারে কিনা এই সহজ প্রশ্নের কোন সহজ উত্তর হয় না।

তথ্যসূত্র
১। ভারতী, জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ্‌ ১২৮৮।
২। নান্দিপট, বার্ষিক নাট্যপত্র, ২০২০, পৃষ্ঠা ২২৯।
৩। তদেব, পৃষ্ঠা ২০০।
৪। আলি আকবর খান, আপনাদের সেবায়, অনুলিখন অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়, সীমা ২০১১,-পৃষ্ঠা ৯৪।
৫। আমার কথা , আলাউদ্দিন খান, শুভময় ঘোষ অনুলিখিত, আনন্দ পাবলিশার্স পৃষ্ঠা ৬৯-৭০।
৬। সংগীতের নৈঃশব্দ শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রী মা – সর্বানন্দ চৌধুরী, পৃষ্ঠা ৪৩।
৭। শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ড-এর ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ অধ্যায়ে।
৮। রামকৃষ্ণলীলা প্রসঙ্গ (স্বামী সর্বানন্দ), উদ্বোধন কার্যালয়, বেলুড় মঠ, পৃষ্ঠা ৮০।

Similar Posts