রবীন্দ্র সংগীত রচনায় সংহতির ভাবনা – ড.নন্দিতা বসু সর্বাধিকারী

‘‘গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি
তখন তারে চিনি, আমি তখন তারে জানি।’’ রবীন্দ্রনাথ বলছেন ‘‘এজগতে আমাদের জীবন যেন কোনও ওক সংগীত শ্রবণ। আমরা যেমন সংগীতের অন্তিম পর্ব অন্বেষণের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি না, বরং তার প্রতিটি অগ্রগতি নিরীক্ষণ করি, ঠিক তেমনি এই জগৎ প্রকৃতই এক, তার খণ্ডগুলি আমাদের ক্লান্ত করে না, আমাদের আনন্দের গভীরতা আরও ব্যাপক হয়ে ওঠে যতই আমরা নিবিড়ভাবে এর একতাকে অনুধাবন করি।’’
সাধারণত সংগীতকে মনে করা হয় মানুষের ভাবপ্রকাশের একটা মাধ্যম এবং চিত্ত-বিনোদনের একটি উপায়মাত্র। কিন্তু গভীর বিশ্লেষণ দেখায় যে সমাজে সংহতি স্থাপন বা বর্ধনের ক্ষেত্রে সংগীতের বড় অবদান আছে। সংগীতের সুরের মাধুর্য্য, ছন্দের দোলার ইত্যাদির প্রতি মানুষের এক দুর্বার সহজাত আকর্ষণ বরাবর লক্ষ্য করা যায়। তার নান্দনিকতার সম্মোহনী শক্তির সাহায্যে সংগীত সময়ে সময়ে মানুষকে একত্রিত করতে, সংহত করতে বিরাট ভূমিকা পালন করে এসেছে। সংগীতকে হাতিয়ার ক’রে যুগে যুগে মানুষ সমাজের সংঘাত ও বিরোধকে জয় করবার চেষ্টা করেছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জুগিয়েছে, শান্তির বাণী শুনিয়েছে সংগীত।
একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে ভারতীয় সংস্কৃতিতে বিভিন্ন বিষয়ে বিপুল প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংগীতের মর্মস্থলে প্রবেশ করতে পারতেন অনায়াসে। প্রায় দুই সহস্রাধিক সংগীত এক অনবদ্য শৈলী গড়ে উঠেছে এবং রবীন্দ্রনাথ বলছেন ‘গান-রচনায় সংগীতের সঙ্গে বাণীর মিলন-সাধনই এখন আমার প্রধান সাধনা হয়ে উঠেছে’। কাব্যিক মূল্যের বিচারে, বিষয় বৈচিত্র্র্যের সমাহারে, নব-নব সুর প্রয়োগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, বৈদগ্ধ্য, সূক্ষ্মতা এবং গভীরতালব্ধ এই রবীন্দ্রসংগীত [অতি সহজেই জনপ্রিয়তা অর্জন ক’রে আসছে এতকাল ধ’রে] যাবতীয় সংস্কার মুক্ত। কবি অনায়াসে অস্পৃশ্যের হাত ধরেছেন, আঞ্চলিক ও বিশ্বের মধ্যে সেতুবন্ধন করেছেন। শুধুমাত্র বঙ্গদেশে নয়, সারা ভারতে তথা বিভিন্ন দেশে তাঁর গান আজ যথাযোগ্য সম্মানে স্বীকৃত ও প্রশংসিত।
ভারতের বৃটিশ আমলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময় বিভিন্ন সংগীত-রচয়িতাদের গান দেশবাসীকে একই ছাতার নীচে সংহত ক’রে বিপুল উদ্দীপনা জাগিয়েছিল দেশমাতৃকাকে বিদেশী শাসন শৃঙ্খলা থেকে মুক্ত করতে। তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ অন্যতম। মাত্র ১৬ বছর বয়সে লেখা গান আমারি তরে মা। স্বল্প বয়স থেকেই জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য কবিকে কংগ্রেস অধিবেশনে সংগীত রচনা ও পরিবেশনও করতে হয়েছে। ১৮৮৬ সালে কলকাতায় কংগ্রেস-অধিবেশনে রামপ্রসাদী সুরে ‘আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে’ গানটি পরিবেশন করেন।
ধর্মের ভিত্তিতে বঙ্গভঙ্গ ঘোষণায় রবীন্দ্রনাথ যারপরনাই বিচলিত হন। তাঁর স্বদেশচেতনা রাজনৈতিক বক্তৃতায়, প্রবন্ধে এবং কালজয়ী দেশাত্মবোধক গানগুলিতে সুস্পষ্টরূপে প্রতিফলিত। লক্ষ্য করবার বিষয় রবীন্দ্রনাথের গানে বৃটিশরাজের প্রতি ঘৃণা, হিংসা-দ্বেষের পরিবর্তে ধ্বনিত হয় অন্তরশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করার কথা, বাংলার সৌন্দর্য বন্দনা, হৃতগৌরব ফিরে পাবার বাসনা।
জাতির আত্মজাগরণ, দেশের হিতে আত্মদান, দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের জন্য জাতির মনে আত্মবিশ্বাস ও নির্ভীকতা সঞ্চার করতে তাঁর গানগুলির অবদান স্মর্তব্য।
বঙ্গভঙ্গকে রদ করতে রবীন্দ্রনাথ যে একগুচ্ছ স্বদেশী গান রচনা করেন তা সমগ্র বাংলার হৃদয়কে নাড়া দিয়েছিল। উল্লেখ্য যে এই গানের অধিকাংশই ছিল বাংলার লোকসংগীত বিশেষত বাউল সুরে প্রভাবান্বিত। মাটির কাছাকাছি সুর, সহজ ছন্দ ও সরল কথা অনায়াসেই আপামর জনগণের মনকে ছুঁতে পারে একথা কবি অনুধাবন করেছিলেন। এব্যাপারে তাঁকে পথিকৃৎ বলা যায়।]
১৬ অক্টোবর, ১৯০৫ দিনটিকে রবীন্দ্রনাথ বেছে নিয়েছিলেন রাখীবন্ধন দিবস হিসেবে। ভাই ভাই এক ঠাঁই’ – এই ছিল সেদিনের মন্ত্র। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এক বাঙালী অপর বাঙালীর হাতে হরিদ্রাবর্ণের সূত্র বেঁধে দিয়ে বাঙালির বন্ধন অটুট রাখার সংকল্প নেয়। প্রাতঃকালে গঙ্গাস্নান ক’রে জনতার মিছিলের আগে আগে উদাত্ত কণ্ঠে ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি’ প্রভৃতি গান গাইতে গাইতে কলকাতা মহানগরীর পথ পরিক্রমা করেন কবি।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন শিলাইদহের মুসলমান গায়ক সুনা-উল্লা নামে এক বাউল একতারা বাজিয়ে গেয়েছিল গগন হরকরা রচিত গান ‘আমি কোথায় পাব তারে ‘বাউলগান গেয়েছিল। সেই গানে অনুপ্রাণিত রবীন্দ্রনাথের গান ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ সর্বত্র বিপুল উৎসাহে তখন গাওয়া হত। কলকাতা টাউন হলে, রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর ‘স্বদেশী সমাজ’ পাঠ করার পর এই গান পরিবেশন করেন, তখন শ্রোতৃবৃন্দও সমবেত কণ্ঠে তাঁর সঙ্গে গাইতে গাইতে নাচতে থাকেন।
লক্ষ্যণীয় রবীন্দ্রনাথ ‘একসূত্রে বাঁধিয়াছি’ বা ‘এবার তোর মরাগাঙে বান এসেছে’-এর মত দু-একটি ব্যতীত রণোপযোগী উদ্দীপক স্বদেশীগান রচনা করেননি। আর ঐ গানগুলিতেও একসূত্রে দেশবাসীর বন্ধনের কথাই কবি বলছেন।
বহু অনুরোধ-উপরোধে ফললাভ না হওয়ায় যখন অহিংস আন্দোলন ক্রমে আক্রমণাত্মক সন্ত্রাসবাদী হয়ে ওঠে, তখন রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করলেন যে তাঁর পথ-সৃষ্টির পথ। ধ্বংসাত্মক পথ থেকে নিজেকে সরিয়ে মনোনিবেশ করলেন তাঁর সৃজনকর্মে, তাঁর শান্তির নীড় শান্তিনিকেতন গঠনে, যেখানে রোপিত হয় বিশ্বমানবতাবোধের বীজ – ‘যত্র বিশ্বম্ ভবতি এক নীড়ম্’
সকলকে প্রীতির বন্ধনে বাঁধবার প্রয়াসই হল ভারতবর্ষের চিরন্তন ধর্ম ।‘বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান’ – ভারত আত্মার এই চিরন্তন ধ্যানটি অনুধাবন করেছিলেন ও চিরদিন আশ্রয় করেছেন রবীন্দ্রনাথ।
তাৎক্ষণিকতার সীমানা ছাড়িয়ে ধ্রুপদী শিল্পীসত্তা উদ্ভাসিত হয়েছে এই পরবর্তী পর্বের গানে। ১৯১২-য় রচিত ‘ভারততীর্থ’, কবিতা তথা গানে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্য উদাত্ত উদার আহ্বান অনুরণিত–
‘হে মোর চিত্ত, পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।’
১৯১১ সালে রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘জনগণমন অধিনায়ক’ ‘ভারতবিধাতা/ব্রহ্মসংগীত’ নামে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯১২-তে মাঘোৎসবে রবীন্দ্রনাথ এই গান পরিবেশন করেন। হুমায়ুন কবীর বলেছেন এটি সমগ্র মানবজাতির ধর্মের মন্ত্র।
জনগণ পথ পরিচায়ক, জনগণ দুঃখ ত্রায়ক, স্নেহময়ী মাতা, ভারতভাগ্যবিধাতা যিনি ইতিহাসের বিচিত্র দুর্গমপথ অতিক্রম ক’রে চলতে পথ দেখান, তাঁরই বন্দনাগান গাওয়া হয়েছে পাঁচ স্তবকের গানটিতে–
‘অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত,
শুনি তব উদার বাণী
হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন পারসিক মুসলমান খৃষ্টানী
পূরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন-পাশে
প্রেমহার হয় গাঁথা।
জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক জয় হে, ভারতভাগ্যবিধাতা
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে।’
মদনপল্লীর James Cousins এগানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন, “It has a true rhythm that makes it singable with definiteness, unity and vigour …” আরও বলছেন –
“Janaganamana specifically recognises the diversity of human life in India and gives it its true unification, not an impossible uniformity of externals, but the real unity that comes of mutual aspiration towards the universal life in which all share.”
Mrs. Margarett Cousins যিনি ১৯৩৭ সালে ‘জনগণমনর’ Staff notation তৈরী করেন, তিনি রবীন্দ্রনাথকে বলছেন ‘The Ssupre Internationalist’. জওহরলাল নেহেরু শান্তিনিকেতনে ভ্রমণকালে কবিকে অনুরোধ করেছিলেন ভারতের জন্য একটি জাতীয় সংগীত রচনা করতে, কিন্তু স্বল্পদিনের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ দেহরক্ষা করেন। স্বাধীনতালাভের ২/৩ বছর পর রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ৯ বছর পর বহু তর্ক-বিতর্কের পর যখন ‘জনগণমন’ ভারতের জাতীয় সংগীত হিসেবে মনোনীত হল, তখন নেহেরুজী যারপরনাই তৃপ্তি ও আনন্দলাভ করেন। উল্লেখ্য, গুরুদেবের ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ গানটি মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ তাঁর পরমারাধ্যকে খুঁজে পেয়েছেন ‘যেথায় থাকে সবার অধম, দীনের হতে দীন, সেইখানে যে চরণ তোমার রাজে, সবার পিছে সবার নীচে, সবহারাদের মাঝে।’ প্রার্থনা করেছেন, ‘ওদের সাথে মিলাও যারা চরায় তোমার ধেনু।’ অথবা ‘চলার পথে দিনে রাতে, দেখা হবে সবার সাথে, তাদের আমি চাব, তারা আমায় চাবে।’ সাধারণের সঙ্গে মিলবার আকুতি ছড়িয়ে আছে আরো বহু রচনায়।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন শান্তির প্রতিভূ – ‘অহিংসা পরমো ধর্ম’।
তাঁর নাটক ‘নটীর পূজা’য় হিংসায় উন্মত্ত, নিষ্ঠুর দ্বন্দ্বে কুটিল জটিল পৃথিবীতে পরম পুরুষ বুদ্ধদেবের পুনরাবির্ভাবের আকুল প্রার্থনা ধ্বনিত এই গানে –
‘শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্ত পুণ্য –
করুণাঘন ধরনীতল কর কলঙ্ক শূন্য।’
অথবা, –
‘সকল কলুষ তামসহর, জয় হোক তব জয়
অমৃতবারি সিঞ্চন কর নিখিল ভুবনময়
মহাশান্তি, মহাপ্রেম, মহাপুণ্য, মহাক্ষেম।’
বুদ্ধের পূজারী নটী শ্রীমতী তার প্রাণ দিয়ে প্রেমশক্তিকে প্রতিষ্ঠা করেছে, পরাজয় ঘটেছে হিংসার। আমরা দেখেছি আরও বিভিন্ন রচনায় যেমন ‘রাজর্ষি’ উপন্যাস বা ‘বিসর্জন’ নাটকেও জয়ী হয়েছে প্রেম।
‘মুক্তধারা’, ‘রক্তকরবী’ প্রভৃতি নাটকে আধুনিক যন্ত্রসভ্যতা ও ধনতন্ত্রের করাল ভয়ঙ্কর দিকটি ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। ধনঞ্জয় বৈরাগী তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠে গান দিয়ে সাধারণ মানুষকে সংহত করেছেন, সাহস জুগিয়েছেন অন্যায় প্রবঞ্চনার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে। তাঁর গানে বাউল সুরের অনুরণন শুনি আমরা। নৃত্যনাট্য ‘চণ্টালিকা’য় সমাজ অচ্ছুতকন্যা প্রকৃতি বুদ্ধের শিষ্য আনন্দকে জলদান করার অধিকার লাভ করে মানুষের মর্যাদায় উন্নীত হয় । তার, বদ্ধ কূপ হল অকূল সমুদ্র যখন আনন্দ নির্দ্বিধায় প্রকৃতিকে আত্মসম্মানে উদ্দীপ্ত করতে বলেন –
‘যে মানব আমি, সেই মানব তুমি কন্যা
সেই বারি তীর্থবারি, যাহা তৃপ্ত করে তৃষিতেরে। ‘
বিশ্বপথিক রবীন্দ্রনাথের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে অবিরাম সংগৃহীত হয়েছে নানান দেশের সাংস্কৃতিক উপাদান । রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন তাঁর মহান উদার মননের জন্য, যার ফলে তাঁর সৃষ্টি- ভান্ডার এত বিপুল সমাহারে সমৃদ্ধ। তিনি যেখানে যা ভালো দেখেছেন তার সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণ করে তাই গ্রহণ করেছেন। পাকা জহুরীর মত মনিমাণিক্য তুলে নিয়ে গেঁথেছেন নিজমালা। কিন্তু অনুকরণ নয়, অনুসরণই ছিল তাঁর পন্থা। তাই এত বৈচিত্র্যপূর্ণ হলেও তাঁর শৈল্পিক নিজস্বতার গুনে সব সৃষ্টি মৌলিকত্ব লাভ করেছে। যা তাঁর কাছে অপ্রয়োজনীয় বা গ্রহণযোগ্য মনে হয় নি তা পরিহার করেছেন তা দেশে বা বিদেশি উপাদান যাই হোক না কেন। চরম দূরদৃষ্টি সম্পন্ন দেবেন্দ্রনাথ সংবেদনশীল ও প্রজাবৎসল রবীন্দ্রনাথকে বেছে নিয়েছিলেন জমিদারি তদারকির দায়িত্ব নিয়ে পূর্ব বাংলায় পাঠাবার জন্য ।১৮৯১ থেকে ১০ বছর (যাকে তাঁর ‘সাধনা পর্ব’ বলা হয় ) বসবাসকালে সেখানকার সাধারণ মানুষ এবং লোকসংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটে তাঁর । বিশেষত উদার সরল সহজ অথচ গভীর তত্ত্বসমৃদ্ধ বাউল দর্শন ও সংগীত রবীন্দ্রজীবনে এবং রবীন্দ্র সংগীতে প্রভূত প্রভাব ফেলেছিল। মন উদাস করা বাউল সুর জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে মিশে গেছে তাঁর রক্তের সঙ্গে, তিনি তা নিজেই বলেছেন। তাঁর গানে কখনো রাগ রাগিনী, কখনো কীর্তন, কখনো বা নিজস্ব সুরের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। রবি বাউলের গানে আমরা শুনি ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে তাই হেরি তায় সকলখানে’ অথবা ‘আমি তারেই খুঁজে বেড়াই যে রয় মনে, আমার মনে’। বাউলরা কখনো সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ কে একবিন্দু প্রশ্রয় দেননি । ১৯৩০ এ আমেরিকায় প্রদত্ত হিবার্ট বক্তৃতায় ‘Religion of Man’অথবা ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ এই তথাকথিত অশিক্ষিত বাংলার বাউলদের ধরার মাঝে অধরা কে রূপের মাঝে অরূপকে বা মনের মানুষকে অন্বেষণের কথা আলোচনা করেছেন, এই মরমিয়া গানের মধ্যে তিনি উপনিষদের বাণীর অনুরণন শুনেছেন ।লালন গীতির ২৯৮ টি গানের পান্ডুলিপি ১৩২২ বঙ্গাব্দে প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশ করার উদ্যোগ নেন রবীন্দ্রনাথ।মোহাম্মদ মনসুর উদ্দিনের ‘হারামণি’ গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন তিনি।
১৯৭২ সালে স্বাধীনতা লাভের শুভ লগ্নে আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ তাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে বেছে নিয়েছিল কবিগুরুর গান ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। এর সহজ সুন্দর কথা ও সুর এত মর্মস্পর্শী যে এ গান শুনতে শুনতে এপার বাংলা ওপার বাংলার দুচোখ জলে ঝাপসা হয়ে যায় । পরিশেষে বলা যায় যে রবীন্দ্রনাথের গানে আমরা পরম শান্তির আশ্রয় পাই যা আমাদের মনকে এক বিশেষ নান্দনিক জগতে উন্নীত করে, এক বিশ্ববোধ জাগ্রত করে ।
‘বিশ্ব সাথে যোগে যেথায় বিহারো সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও’
তথ্যসূত্র (References):
1. ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ. রবীন্দ্র রচনাবলী, বিশ্বভারতী সংস্করণ।
2. ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ. ছিন্নপত্রাবলী।
3. ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ. The Religion of Man. Macmillan, 1931.
4. Cousins, James. “The National Anthem of India,” Indian Review, 1912.
5. Cousins, Margaret. Staff Notation of Jana Gana Mana, 1937.
6. মনসুরউদ্দিন, মোহাম্মদ। হারামণি (সম্পা.)।
7. রায়, অমলেন্দু বিকাশ। রবীন্দ্রসংগীত ও সমাজচেতনা, বিশ্বভারতী প্রকাশন।
8. ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ। আত্মচরিত (রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে)।
9. Majumdar, A.K. Rabindranath Tagore and Nationalism.
10. Chakravarty, Amiya. A Tagore Reader, Beacon Press, 1961.