প্রকৃতির অন্য চেতনায় ‘পথের পাঁচালী’-উদয় নারায়ণ সাহা
সারসংক্ষেপ :
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যচেতনার মূল ভিত্তি প্রকৃতি ও মানুষ—এই দুইয়ের মেলবন্ধন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেখানে মানবপ্রকৃতি ও বিশ্বপ্রকৃতির একাত্মতাকে তুলে ধরেছেন, সেখানে বিভূতিভূষণ সেই ধারা থেকে সরে এসে এক বাস্তব, জীবন্ত ও অনাড়ম্বর প্রকৃতির রূপ অঙ্কন করেছেন। ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে প্রকৃতি শুধু পটভূমি নয়, জীবন্ত চরিত্রের মতো উপস্থিত—যেখানে কাশবন, উলুখড়, বকুল, পলতা, তুঁত গাছ, পাখির ডাক, বর্ষার সোঁদা গন্ধ, ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ—সব মিলিয়ে এক অনুপম জীবনের সঙ্গীত তৈরি করেছে। অপু ও দুর্গার জীবনে প্রকৃতি হয়ে উঠেছে বন্ধু, সহচর ও শিক্ষক। দারিদ্র্য, কৌতূহল ও আনন্দ—সবই প্রকৃতির ছায়ায় বিকশিত হয়েছে। এই উপন্যাসে ঔপন্যাসিক দেখিয়েছেন, মানুষ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হলে তার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়। বর্তমান শিল্পায়ন ও নগরায়নের যুগে তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবেশ সচেতনতার দিক থেকেও প্রাসঙ্গিক। ফলে ‘পথের পাঁচালী’ শুধু এক গ্রামীণ জীবনের কাহিনি নয়, এটি প্রকৃতি ও মানুষের অবিচ্ছেদ্য আত্মিক সম্পর্কের এক অনুপম দলিল।
সূচক শব্দ :
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, পথের পাঁচালী, প্রকৃতি চেতনা, গ্রামীণ জীবন, পরিবেশ সচেতনতা, অপু ও দুর্গা, বাংলা উপন্যাস, বাস্তব প্রকৃতি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্ব প্রকৃতির সাথে মানব প্রকৃতির যে মেলবন্ধন আমরা দেখতে পাই, সেই মেলবন্ধন থেকে কিছুটা সরে এসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় অঙ্কন করলেন অন্য এক প্রকৃতি। বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে তিনি এক অনন্য মাত্রা এনে দিয়েছেন, তাঁর সৃষ্টিকর্মের শৈল্পিক কৌশল ও অন্তরের স্বতন্ত্র উপলব্ধির দ্বারা। কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যের মতো মেঘকে দূত করে তিনি না পাঠালেও প্রকৃতির সৌন্দর্যে অবগাহন করেছেন। তাঁর লেখনীতে প্রকৃতি জীবন্ত বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো হয়ে উঠেছে। ‘পথের পাঁচালী’(১৯২৯) উপন্যাসে তুচ্ছ বস্তু হয়ে উঠেছে মহত্তম। যেখানে জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে তুচ্ছ বস্তুকে কবিতায় স্থান দিয়েছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়েরও তাঁর উপন্যাসে প্রকৃতির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গাছপালা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গকে নিবিড় ভাবে তুলে ধরেছেন। আধুনিক তথা উত্তর আধুনিক সময়ে শিল্পায়ন, নগরায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশ ধ্বংসের মুখে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে। সমসাময়িক কবি সাহিত্যিক অবিরত পরিবেশ রক্ষার বার্তা দিয়ে চলেছেন বিভিন্ন রকম ভাবে; নদী ভাঙ্গন, বন উজাড়, বন্যপ্রাণীর বিলুপ্তি ও জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে। পৃথিবীর প্রাচীনতম সাহিত্য ‘বেদ’ থেকে শুরু করে ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’, ‘চর্যাপদ’, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, মধ্যযুগের সাহিত্য থেকে আধুনিক সাহিত্য পর্যন্ত প্রকৃতি হয়ে উঠেছে অনন্য অনুষঙ্গ। আধুনিক যুগে কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে মোহাম্মদ রফিক, নির্মলেন্দু গুণ, বিমল মিত্র, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো প্রমুখ কবি সাহিত্যিক প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রকার গ্রন্থ রচনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যে পরিবেশ চেতনা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে, রোমান্টিক প্রকৃতি প্রীতি থেকে শুরু করে পরিবেশ রক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির আন্দোলন; যা শুধুমাত্র সৌন্দর্যবোধ নয় দায়িত্ববোধের বহিঃপ্রকাশ। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ প্রকৃতি চেতনার প্রতিনিধি স্থানীয় উপন্যাস। এই উপন্যাসে ঔপন্যাসিক প্রকৃতিকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন, যা আমাদের নিজস্ব পরিচিত জগতকে আরো একবার মনে করিয়ে দেয়। প্রকৃতি শুধু জীবনের ভিত্তি নয়, এটি আমাদের আনন্দ, অনুপ্রেরণা ও শক্তির উৎস। প্রকৃতি না থাকলে মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন হতো। মানুষ মাত্রই প্রকৃতির সন্তান, কেননা হাসি-কান্না, দুঃখ, যন্ত্রণা, কৌতূহল কিংবা খেলাধুলার রসদ আমরা প্রকৃতি থেকেই পেয়ে থাকি। একথা বলা যেতেই পারে প্রকৃতির নিয়মেই সমস্ত কিছু ঘটে থাকে। তাই আমরা প্রতিনিয়ত প্রকৃতির কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করে চলেছি সুনির্মল বসুর ‘সবার আমি ছাত্র’ কবিতার মতো।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে যে তুচ্ছ থেকেও তুচ্ছতম বস্তু স্থান পেয়েছে তা আমাদের কাছে এক দুর্লভ জিনিস। যে সমস্ত জীব, কীটপতঙ্গ, গাছপালা, ঝোপঝাড়ের কথা বলা হয়েছে তা বর্তমান সময়ে খুব কম দেখা যায় বা আমরা অনেকেই তা চিনি না। তাঁর উপন্যাসের স্থান পেয়েছে—শ্যামা ঘাসের দাম, কাশ ঝোপ, ভাঁট, বৈঁচি, শোলা, উলুখড়, সোঁদাল, আলকুশি, বনবিছুটি, নোনা, শেয়াকুল, কন্টিকারী, রাংচিতা, ষাঁড়া, গাব, পলতা, কালকাসুন্দে, কচু-ওল ইত্যাদি লতাপাতা ঝোপঝাড়। এছাড়াও গাছপালার মধ্যে দেখতে পায়— বাবলা, ঝুপসি, বকুল, বেল, ছাতিম, নারকেল, তুঁত, নাগকেশর, তিত্তিরাজ, কদম, শিরীষ, আকন্দ, বনডুমুর, অর্জুন, কামরাঙ্গা ইত্যাদি এবং কীটপতঙ্গের মধ্যে দেখা যায়—সুদর্শন পোকা, নীলকন্ঠ পাখি, বেনে বউ, খঞ্জনা, বউ কথা কও, গাংচিল, তেরো পাখি, কাঁচপোকা ইত্যাদি। যা পথের পাঁচালী উপন্যাসকে অনন্য মাত্রা দান করেছে। এর থেকে বোঝা যায় বিভূতিভূষণ কতটা প্রকৃতি প্রেমিক ছিলেন। প্রকৃতির নিবিড় ছায়ায় বেড়ে না উঠলে বিভূতিভূষণ এই সমস্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়গুলি উত্থাপন করতে পারতেন না। তাই বলা যায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক অনুভূতিপ্রবণ অনন্য রসগ্রাহী প্রকৃতি প্রেমিক।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকৃতিকে অনুভব করতেন; এক কথায় গায়ে মাখতেন প্রকৃতির নিবিড় ছায়া। তাঁর বেশিরভাগ উপন্যাসে প্রকৃতি চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, সেখানে প্রকৃতি শুধু পটভূমি নয়; প্রকৃতি জীবন্ত চরিত্রের মতো ধরা দিয়েছে। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ প্রকৃতির চিত্রশালা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনায় মানুষ ও প্রকৃতি আলাদা কোন সত্ত্বা নয়, বরং তারা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তাঁর বর্ণনায় চাঁদের আলো, পাখির ডাক, নদীর বহমানতা, সূর্যাস্ত, বন-জঙ্গল এক কাব্যিক আবেশ তৈরি করে। তাঁর প্রকৃতি চেতনার মধ্যে গরিব ও নিম্নবিত্তদের প্রতি ভালোবাসা ছিল অগাধ। তিনি শোষণের বিরুদ্ধে গরিব মানুষকে লড়াই করতে শিখিয়েছেন। তাঁর প্রকৃতি চেতনার মূলে ছিল ঈশ্বর বিশ্বাস ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা। তিনি পরবর্তী জন্মে দীনহীন কাঙালের পর্ণ কুটিরে অভাব অনটনের মধ্যে প্রকৃতির কোলে জন্মগ্রহণ করতে চেয়েছেন। তাই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘স্মৃতির রেখা’ দিনলিপি তে বলেছেন—
“গভীর রাত্রি পর্যন্ত বড় বাসার ছাদে বসে মেঘলা রাতে কত কথা মনে আসে—আবার যদি জন্মই হয় তবে যেন ঐরকম দিনহীনের পর্ণ কুটিরে অভাব অনটনের মধ্যে, পল্লীর স্বচ্ছতায় গ্রাম্য নদী গাছপালা নিবিড় মাটীর গন্ধ অপূর্ব সন্ধ্যা মোহভরা দুপুরের মধ্যেই হয়—যে জীবনের অ্যাডভেঞ্চার নেই উত্থানপতন নেই— সে কি আবার জীবন? সেই পুতু পুতু ধরনের মেয়েলি একঘেয়ে জীবন থেকে ভগবান তুমি আমায় রক্ষা কোরো”।[1]
এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট নিশ্চিন্দিপুর নামক একটি ছোট গ্রাম। গ্রামটির পরিবেশ শান্ত, মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক শোভা দিয়ে আবৃত। যেখানে আমরা দেখতে পাই কাশবন, আমবাগান, বাঁশ বাগান, কুঠির মাঠ, বঁয়শার বিল। উপন্যাসে বিশেষ করে অপু ও দুর্গার মধ্যে যে প্রকৃতি চেতনা ধরা দিয়েছে তা পাঠক মাত্রই বিস্মিত হয়। প্রকৃতি এখানে তাদের বন্ধু, তাদের আনন্দ ও বেদনার সাথী। দুর্গা এখানে স্বয়ং প্রকৃতির আশীষ ধন্যা। সদা সর্বদা সে প্রকৃতির সাথে এমন ভাবে সংযুক্ত যে দুর্গাকে বাদ দিলে প্রকৃতি যেন ম্লান হয়ে যায়। শৈশবকালে প্রকৃতির সাথে অপুর পরিচয় ঘটে বাবা হরিহরের হাত ধরে, সরস্বতী পূজার দিন নীলকন্ঠ পাখি দেখবার জন্য কুঠির মাঠ যাত্রার মধ্য দিয়ে। কুঠির মাঠের বিবরণ ঔপন্যাসিক তুলে ধরেছেন—
“মাঠের ঝোপঝাপগুলো উলুখড়, বনকলমী সোঁদাল ও কুল গাছে ভরা। কলমীলতা সারা ঝোপগুলার মাথা বড় বড় সবুজ পাতা বিছাইয়া ঢাকিয়া দিয়াছে—ভিতরে স্নিগ্ধ ছায়া, ছোট গোয়ালে, নাটাকাঁটা, ও নীল বন–অপরাজিতা ফুল সূর্যের আলোর দিকে মুখ উঁচু করিয়া ফুটিয়া আছে, পড়ন্ত বেলার স্নিগ্ধ বনভূমির শ্যামলতা, পাখীর ডাক, চারিধারে প্রকৃতির মুক্ত হাতে ছড়ানো ঐশ্বর্য রাজার মতো ভান্ডার বিলাইয়া দান, কোথাও এতটুকু দারিদ্র্যের আশ্রয় খুঁজিবার চেষ্টা নাই, মধ্যবিত্তের কার্পণ্য নাই। বেলাশেষের ইন্দ্রজালে মাঠ, নদী, বন মায়াময়”।[2]
তারপর দিদি দুর্গার হাত ধরে প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা এবং প্রকৃতির সাথে একান্ত যোগাযোগ স্থাপন। এককথায় বলা যায় দুর্গার চোখ দিয়েই অপুর প্রথম প্রকৃতি দেখা। বনের পথে হাটা, রেলগাড়ি দেখার জন্য দূরের পথ অতিক্রম করা, কাশবনে দৌড়ে যাওয়া, আম গাছ তলায় ভাই বোনের আম কুড়ানো, পেঁপে তলায় পুন্যি পুকুর ব্রত পালন ইত্যাদি বিষয় আমাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠে। আবার কখনো বা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, বর্ষার স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া, শীতের শুষ্ক পরিবেশও আমাদের মনমুগ্ধ করে তোলে। সমালোচক ডঃ তারক নাথ ঘোষ যথার্থই বলেছেন—
“অপুর বিশ্বতোমুখ কল্পনার মূলে আছে প্রকৃতির প্রেম। রবীন্দ্রনাথ জীবনদেবতা থেকে বিশ্ব দেবতায় পৌঁছেছেন। অপুর আদিতে বাংলার প্রকৃতি, মধ্যে ভারত প্রকৃতি, অন্ত্যে বিশ্ব প্রকৃতির প্রতি অনুরাগ। এই অনুরাগ একটি গভীর অনুভূতি বা জিজ্ঞাসার অভিমুখী হয়েছে”।[3]
অপু ও দুর্গা প্রকৃতির সাথে এমন ভাবে সম্পৃক্ত হয়েছিল যে কখন কোন গাছে ফুল ফুটবে, কোন গাছে ফলগুলো পাকার সময় হয়েছে সবকিছুই যেন তাঁদের জানা। কালবৈশাখী ঝড়ের মধ্যেও অপু দুর্গার আম কুড়োতে যাওয়া এক অন্তহীন পথ। সে পথে আমরা প্রত্যেকেই বোধহয় অবগাহন করেছি ছোটবেলায়। যেখানে আমরা দেখতে পাই—
“দুর্গা ছুটিতে ছুটিতে বলিল -শিগগির ছোট, তুই বরং সিঁদুর কৌটা- তলায় থাক আমি যাই সোনামুখী -তলায় -দৌড়ো- দৌড়ো। ধূলায় চারিদিক ভরিয়া গিয়াছে- বড় বড় গাছের ডাল ঝড়ে বাঁকিয়া গাছ নেড়া- নেড়া দেখাইতেছে। গাছে গাছে সোঁ সোঁ, বোঁ বোঁ শব্দে বাতাস বাধিতেছে- বাগানে শুকনো ডাল, কুটা, বাঁশের খোলা উড়িয়া পড়িতেছে…”।[4]
বর্তমান পরিস্থিতিতে আম কুড়াতে যাওয়া যেন এক পুরাতন ইতিহাস। সেই ইতিহাসের পাতা খুলে কেউ কয়েকবার পড়ি মাত্র, কিন্তু ইতিহাসকে বাস্তবতার মধ্যে খুঁজতে হয়তো কয়েকজন যায়। অপু ও দুর্গার রেলগাড়ি দেখার জন্য যে যাত্রা তা যেন অসীম যাত্রা । “দৌড় দৌড় দৌড় জীবনে এই প্রথম বাধাহীন, গন্ডীহীন মুক্তির উল্লাসে তাহাদের তাজা তরুণ রক্ত তখন মাতিয়া উঠিয়াছিল”।[5] আবার প্রকৃতির এক বিরূপ চিত্র দেখি বর্ষাকালে, যেখানে বৃষ্টির জল দুর্গাদের ঘরের চালের ছিদ্র দিয়ে অনবরত পড়ে চলেছে। এ যেন প্রকৃতির এক ভয়ংকর রূপ, নির্মম রূপ; চরম দারিদ্রের কঠিন বাস্তব রূপ। দুর্গা ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। ঘরে খাবার নেই, দুর্গার ঘোরলাগা আচ্ছন্ন ভাব, সাড়া শব্দ নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভেতরেই প্রকৃতির কোলে অকালেই ঝরে যাওয়া। এও যেন এক প্রকৃতির নিয়ম, যে নিয়মের কখনো তারতম্য বা ব্যতিক্রম ঘটে না। জীবনের সৃষ্টি থেকে শুরু করে বৃদ্ধি, বিকাশ এমনকি মৃত্যু সবই প্রকৃতির নিয়মের অংশ। এখানে প্রকৃতির হাসি-কান্নার সাথে মানুষের হাসি-কান্না এক হয়ে গেছে। এ বন্ধন আজীবন কাল ধরে চলতেই থাকবে ।
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এক আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে, দুর্গা এবং অপু হল সেই আত্মিক সম্পর্কের প্রতিনিধি। তাঁরা প্রকৃতির গন্ধ গায়ে মাখে এবং অনুভব করে। তাই যখন অপু গঙ্গানন্দপুরের সিদ্ধেশ্বরী ঠাকুরবাড়িতে পুজো দিতে যায় তখন ঔপন্যাসিক অপুর শৈশবের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক তুলে ধরেন—
“অপুর শৈশব কাটিতেছিল এই প্রকৃতির সহিত ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে। এক ঋতু কাটিয়া গিয়া কখন অন্য ঋতু পড়ে—গাছপালায়, আকাশে বাতাসে, পাখির কাকলীতে তাহার বার্তা রটে। ঋতুতে ঋতুতে ইছামতীর নব নব পরিবর্তনশীল রূপ সম্বন্ধে তাহার চেতনা জাগ্রত হইয়া উঠেছিল—কোন্ ঋতু গাছপালায় জলে–স্থলে–শূন্যে ফুলে ফলে কি পরিবর্তন ঘটাই তাহা সে ভালো করিয়া চিনিয়া ফেলিয়াছিল। ইহাদের সহিত এই ঘনিষ্ঠ যোগ সে ভালোবাসে, ইহাদের ছাড়া সে জীবন কল্পনা করিতে পারেনা। এই বিরাট অপরূপ ছবি চোখের উপরে রাখিয়া সে মানুষ হইতেছিল”।[6]
প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে যে মেলবন্ধন ঘটেছে ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে, বর্তমান সভ্যতায় সেই মেলবন্ধনে কিছুটা চিড় ধরেছে । এখন প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যেই নাগরিক সভ্যতার বীজ গ্রোথিত হয়েছে, ক্রমশই তারা প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রকৃতিও তাদের প্রতিমুহূর্তে নিরাশ করছে বা ভয়ংকর রূপ দেখাচ্ছে কখনো বন্যা, ভূমিকম্প, সুনামি, দাবানল, উষ্ণতা বৃদ্ধি আবার কখনো অগ্নুৎপাত, ভূমিধ্বস, শক্তিশালী ঝড়। যার ফলে জনজীবন বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে। ঔপন্যাসিক এখানে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মানুষদের প্রতি প্রতিবাদ ঘোষণা করলেন। অপু যখন নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে কাশীর পথে যাত্রা আরম্ভ করলো তখন থেকেই অপু সহ হরিহর ও সর্বজয়া বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো প্রকৃতির ছায়া থেকে। এসে উঠল যান্ত্রিক শহরে, যেখানে আমবাগান, বাঁশঝাড়, কাশবন কিছুই নেই। আধুনিকযুগে আমরা প্রত্যেকেই যেন যন্ত্রচালিত মেশিনে পরিণত হয়েছি। অনবরত আমাদের সাথে পরিচয় হচ্ছে নতুন নতুন যন্ত্রাংশের। যেখানে প্রকৃতি মানুষের সুখ দুঃখের সাথে অনবরত পাশে থেকেছে, গ্রামীণ জীবনসহ ঔপন্যাসিকের প্রকৃতি সচেতনতা সুন্দরভাবে ধরা পড়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকৃতির যে টালমাটাল পরিস্থিতি যেখানে প্রকৃতির সাথে আমাদের প্রত্যক্ষভাবে যোগাযোগ খুবই কম। ফলে প্রকৃতির সাথে আমাদের যে আত্মিক সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন তা আর হয়ে ওঠে না। ফলে ক্রমেই আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু বিচ্ছিন্ন হননি, বরং তিনি প্রকৃতির একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে উঠেছেন। যাঁর প্রতিনিধিত্ব স্থানীয় ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের অপু চরিত্র। আমরা প্রত্যেকে যদি প্রকৃতিকে সুন্দরভাবে ভালোবাসি ও প্রকৃতির নিয়মকে মেনে চলি তাহলে প্রকৃতি আমাদেরকে দুহাত উজাড় করে প্রতিনিয়ত সাহায্য করবে। একথা বলা যেতেই পারে যে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে প্রকৃতি ছিল অন্তর্লোকের প্রকৃত বাসভূমি। তিনি প্রকৃতির মধ্যে শান্ত শ্যামল রূপ খুঁজে পেয়েছিলেন। তাই তিনি প্রকৃতির কথা নিজস্ব অনুভূতির দ্বারা শুনতে পারতেন আর প্রকৃতি ও তাকে বারবার হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকতো। ফলে তিনি সর্বদা আনন্দের সাথে প্রকৃতি ঘোলা নির্জনতা অনুভব করতেন। আর এই অনুভূতিগুলি নিজে উপলব্ধি করে অপু বা দুর্গার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন; যা তাঁর অনুভবের সরল স্বীকারোক্তি। তাই বলা যেতেই পারে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত প্রকৃতিকে এত কাছ থেকে গভীরভাবে অনুভূতি দিয়ে উপলব্ধি করতে কেউ পারেনি, এখানেই ঔপন্যাসিকের স্বতন্ত্রতা লক্ষ্য করা যায়।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি:
১. মাহমুদ, অনীক। বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী: তন্মিষ্ঠ পাঠ ও শিল্প সন্দর্শন। দ্বিতীয় সংস্করণ, জোনাকী প্রকাশনী, ২০১০, কলকাতা।
২. মুখোপাধ্যায়, অরুণ কুমার। কালের প্রতিমা। প্রথম প্রকাশ, দে’জ পাবলিশিং, ১৯৭৪, কলকাতা।
৩. গঙ্গোপাধ্যায়, দুর্গাপদ, ও সুনীল কুমার দে। পথের পাঁচালী যুগ্ম সমীক্ষা। গ্রন্থ বিকাশ, সেপ্টেম্বর ২০১৯, কলকাতা।
৪. পান্ডে, বিশ্বজিৎ। পথের পাঁচালীর আঁকে বাঁকে। রত্নাবলী, জুলাই ২০১২, কলকাতা।
৫. বন্দ্যোপাধ্যায়, অসিতকুমার। বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত। মডার্ন বুক এজেন্সি, ২০১১–১২, কলকাতা।
৬. চট্টোপাধ্যায়, তপন কুমার। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস। প্রজ্ঞা বিকাশ, এপ্রিল ২০১৬, কলকাতা।
৭. চট্টোপাধ্যায়, পার্থ। বাংলা সাহিত্য পরিচয়। তুলসী প্রকাশনী, আগস্ট ২০১৬, কলকাতা।
[1] স্মৃতির রেখা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩২-৩৩
[2] পথের পাঁচালী, সপ্তম পরিচ্ছেদ
[3] জীবনের পাঁচালীকার বিভূতিভূষণ, ডঃ তারকনাথ ঘোষ,পৃষ্ঠা সংখ্যা ৭৬-৭৭।
[4] পথের পাঁচালী, এয়োদশ পরিচ্ছেদ
[5] পথের পাঁচালী, ষোড়শ পরিচ্ছেদ
[6] পথের পাঁচালী, অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ
উদয় নারায়ণ সাহা, এডুকেটর অ্যাসিস্ট্যান্ট,বাংলা বিভাগ
দ্বিজেন্দ্রলাল কলেজ,কৃষ্ণনগর, নদীয়া
চলদূরবাণী-৭৬৯৯৭২১৭৫৫