কর্মের আনন্দযজ্ঞে রবীন্দ্রনাথ – ঋদ্ধি পান
গবেষক, বাংলা বিভাগ, ডায়মন্ডহারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়
চিঠিপত্র অষ্টম খণ্ডে রবীন্দ্রনাথের লেখা একটি চিঠি থেকে জানা যায় — “দেনা যে ক্রমে কত বেড়ে যাচ্ছে সে বলতে পারি নে। এদিকে আমাদের মাসহারা বহুকাল থেকে অর্দ্ধেক বন্ধ হয়ে আছে, কি করে যে শুধ্ব ভেবে পাই নে। আমার বয়সে আমি কখনো এমন ঋণগ্রস্ত এবং বিপদগ্রস্ত হইনি।” পতিসরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যাংক স্থাপনের প্রসঙ্গটি এই চিঠিকে ঘিরে রয়েছে। এটি তাঁর অনন্য কীর্তি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিত্বের তথাকথিত সাহিত্যিকের মর্যাদা বোধ ঘুচিয়ে অন্য আরেক রবীন্দ্রনাথকে যখন চিনব তখন চলে আসবে তাঁর জমিদারি ব্যবস্থার নানা সংকল্প। কর্মের এই রবীন্দ্রনাথ পাঠকের কাছে বেশ দুর্লভ। ‘পল্লীপ্রকৃতি’তে রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছেন — “আজ আপনারা কবি রবীন্দ্রনাথকে নয়, তার কর্মের অনুষ্ঠানকে প্রত্যক্ষ করুন, দেখে লিখুন, সকলকে জানিয়ে দিন কত বড় দুঃসাধ্য কাজের ভেতরে আমাকে জড়িয়ে ফেলতে হয়েছে।”
জমিদারী দায়িত্ব পালনের সময় থেকেই তাঁর এই কর্মের সাধনা শুরু। এক্ষেত্রে শিলাইদহ পর্বটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই শিলাইদহ পর্বেই তিনি গ্রামের মানুষের কাছাকাছি আসেন এবং তাদের নানা সমস্যার বিষয় কাছ থেকে উপলব্ধি করেন। গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা, তাদের যথাযথ শিক্ষা, দারিদ্র দূরীকরণে এবং বেঁচে থাকার উপযুক্ত পরিবেশ গঠনে, এক কথায় পল্লীসমাজের পুনর্গঠনে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এক্ষেত্রে গান্ধীজির মতাদর্শকে মানেননি। চরকার ব্যবহার বা দেশীয় দ্রব্যের প্রতি তাঁর আগ্রহ যে ছিল না তা নয় কিন্তু বিদেশি যন্ত্র, বিদেশি কৃষি পরিকল্পনা গ্রহণে এই সার্বিক উন্নয়ন যে সুষ্ঠরূপে পালিত হতে পারে তা তিনি অনুভব করেন। একটি বিজ্ঞান নির্ভর সর্বাত্মক পল্লীসংস্কারের চেষ্টা করেন যেখানে দেশের সকলেই তাঁকে সমর্থনও করেন। রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজীর চরকা নীতির বিরোধিতা করে ১৯২১ সালে ‘সত্যের আহ্বান’ নামে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। মডার্ন রিভিউতে এই প্রবন্ধটির ইংরেজি অনুবাদ ‘The call of truth’ নামে প্রকাশিত হয়। যদিও গান্ধীজীর স্বরাজ অধিকারের নীতিটিকে রবীন্দ্রনাথ সমর্থন করেন। গ্রামের মানুষের শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধা, একে অন্যের সঙ্গে সহায়তায় কর্মসম্পাদনটিকে এনারা দুজনেই সমর্থন করেছিলেন।
বিশ শতকের দুইয়ের দশকে পূর্বেই মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ পল্লী গঠনের কথা নর-নারীর মুখে প্রচলিত ছিল। এর পূর্বেই সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে দেশ সেবার পন্থা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের আলোচনা হয়, তখনই গ্রামের পুনর্গঠন নিয়ে তিনি তার অভিমত সুভাষচন্দ্র বসুকে জানান। তিনি মনে করতেন যুবসমাজকে একবার আলোড়িত করতে পারলেই তাদের আত্মবলিদানের মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠবে নতুন গ্রাম। যেমন ছিলেন কালীমোহন ঘোষ। মানুষের একত্রিত করার উপর অধিকতর গুরুত্ব দেন। ভারতবর্ষের উন্নয়ন এবং বিদেশী শাসন মুক্ত স্বরাজ অধিকারে নগর অপেক্ষা গ্রামগুলির উন্নয়ন এবং পুনর্গঠনই যে একমাত্র উপায় তিনি উপলব্ধি করেন। সে ক্ষেত্রে মূল সমস্যা ভারতবর্ষের গ্রামগুলির অন্ধকারে থাকা। ভারতবর্ষের এই বিপুল পরিমাণ দারিদ্র দূরীকরণ করতে হলে শিক্ষা ব্যবস্থায় যে একটি পরিবর্তন আনতে হবে তা তিনি উপলব্ধি করেন। আধুনিক শিক্ষার রূপ যে আশ্রমিক হলে ভালো হবে এবং তার গুরুকেন্দ্রিক এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে হলে মননের উন্নতি হবে বুঝেছিলেন। ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’, ‘বিশ্বভারতী’ প্রবন্ধে তিনি এই পরিকল্পনার কথাগুলি উল্লেখ করেছেন। ‘বিশ্বভারতী’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন — “ভারতবর্ষে যদি সত্য বিদ্যালয় স্থাপিত হয় তবে গোড়া হইতেই সে বিদ্যালয় তার অর্থশাস্ত্র, তাহার কৃষিতত্ত্ব, তাহার স্বাস্থ্যবিদ্যা, তাহার সমস্ত ব্যবহারিক বিজ্ঞানকে আপন প্রতিষ্ঠাস্থানের চতুর্দিক পল্লীর মধ্যে প্রয়োগ করিয়া দেশের জীবনযাত্রার কেন্দ্রস্থান অধিকার করিবে। এই বিদ্যালয় উৎকৃষ্ট আদর্শ চাষ করিবে, গোপালন করিবে, কাপড় বুনিবে এবং নিজের আর্থিক সম্বল লাভের জন্য সমবায় প্রণালী অবলম্বন করিয়া ছাত্র শিক্ষক ও চারিদিকের অধিবাসীদের সঙ্গে জীবিকার যোগে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হইবে। এইরূপ আদর্শ বিদ্যালয়কে আমি বিশ্বভারতী নাম দিবার প্রস্তাব করিয়াছি।” শিক্ষাকে নানা ব্যবহারিক দিক দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক সদগতি সাধনই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। এই যে আশ্রমিক শিক্ষায় প্রাণগতস্পর্শ, যান্ত্রিকতা মুক্ত জীবন, মনের সঙ্গে সংযুক্তি এই বিষয়টি শিক্ষার বিকাশে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেইটি তিনি উল্লেখ করেছেন ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’ প্রবন্ধটিতে। গুরু ও তাঁর মনটিকে একেবারে নিরস না করে ফেলেন সেইদিকের খেয়ালও তিনি রাখতে বলেছেন সর্বদা। আসলে মনের একটি উন্মুক্ততা তিনি চেয়েছিলেন। নিজের চেষ্টায় নিজেকে প্রকৃতির কোলে বড় করার মধ্যে দিয়ে একজন শিশু কতটা নিজেকে সুশৃঙ্খল এবং দায়িত্ববোধ সম্পন্ন করে তুলতে পারে সেটা তিনি জানতেন। পরনির্ভরতার লজ্জা থেকে মুক্তি লাভ করে আত্মশক্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে চলবার যে শিক্ষা সেটি তিনি দিতে চেয়েছিলেন। সর্বোপরি বেঁচে থাকার জন্য পরিপূর্ণতার শিক্ষাই ছিল তাঁর কাছে প্রকৃত শিক্ষা। তিনি নিজেও ব্যক্তিজীবনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে স্থান দিতে চাননি। তিনি মনে করতেন — “মরা মন নিয়েও পড়া মুখস্ত করে পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীর ঊর্ধ্বশিখরে ওঠা যায়; আমাদের দেশে প্রত্যহ তার পরিচয় পাই … প্রথম থেকে আমাদের সংকল্প এই ছিল, আমার আশ্রমের ছেলেরা চারিদিকের জগতের অপব্যবহিত সম্পর্কে উৎসুক হয়ে থাকবে, সন্ধান করবে, পরীক্ষা করবে, সংগ্রহ করবে …।” প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে দিয়ে আন্তরিক শিক্ষালাভই তাঁর শিক্ষানীতির মূল কথা। “… রাষ্ট্রতন্ত্রেই কি আর শিক্ষাতন্ত্রেই কি, কঠোর শাসননীতি শাসয়িতারই অযোগ্যতার প্রমাণ।” এই শিক্ষা পদ্ধতিটি তাঁর কর্মজীবনের সর্বক্ষেত্রের ‘সমবায়’ নীতিকেই সমর্থন করে। সামঞ্জস্য, সকলে মিলে সহযোগিতার শিক্ষা, প্রাণশক্তির মিলনে আবদ্ধ হয়ে মনুষ্যত্বের সত্য প্রতিষ্ঠা যেন। এই স্বনির্ভর দেশীয় আত্মশক্তি গড়বার প্রয়াসেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়, বিশ্বভারতী, শ্রীনিকেতন সমিতি। পূর্বেই উল্লেখ করেছি দারিদ্র্য দূরীকরণই তাঁর কর্মের লক্ষ্য। গ্রামগুলির পুনর্গঠন এর মধ্যে দিয়ে দেশের সার্বিক তথা আর অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্রতী হয়েছিলেন।
সারা বছর ধরে গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার যাতে থাকে সেইজন্য কৃষি এবং শিল্পের নিরবিচ্ছিন্ন উৎপাদন এবং আধুনিক যন্ত্রের প্রয়োগ, নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা এগুলির প্রতি জোর দেন। কৃষির উন্নতির শিক্ষা গ্রহণের জন্য পুত্র ও জামাতাকে আমেরিকায় পাঠিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের এই কাজ শিখে কর্মপদ্ধতির প্রয়োগ তাঁর সাহিত্যকর্মের ক্ষেত্রেও আমরা দেখি। বই বাঁধাই এর কাজ শিখতে ছাত্রদের পাঠাতেন। এই প্রয়োগমূলক শিক্ষাকেই শিক্ষার ক্ষেত্রে জোর দিয়েছিলেন। বীরভূমের নীরস কঠোর জমির মধ্যে সেই বীজবপন কাজের পত্তন করেছিলেন। তিনি মনে করতেন সৃষ্টির আনন্দপ্রবাহে নানা দিক থেকে পল্লীর শুষ্কতাকে আত্মপ্রকাশের নানা পথ খুলবে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও বিদেশ থেকে এমন কিছু যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করেছিলেন যা নিরক্ষর চাষী সহজেই ব্যবহার করতে পারে। কৃষির পাশাপাশি সারা বছর নানা কুটির শিল্প যেমন — মৌমাছি পালন, হাঁস মুরগি পালন, মাছ চাষ, জাল বোনা, পাটের দড়ি, ছাতা, রেশম শিল্প, শিমুল তুলো উৎপাদন এবং এগুলি রপ্তানির ব্যবস্থা করেন। গ্রামীন তাঁতিদের ন্যায্য মূল্যে ব্যবসার জন্য তিনি পাণ্টির হাটের সূচনা করেন। এতে দেশীয় কাপড়ের ব্যবহার ও চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে অর্থনৈতিক দিক থেকে গ্রামের মানুষের শক্তিবৃদ্ধি হয়। সমবায় পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে জীবন ও জীবিকা অর্জনের জন্য গ্রামের মানুষের সামাজিকতা এবং জোটবদ্ধতাই যথেষ্ট ছিল আয়ার্ল্যান্ডের ‘National Being’ এর সমবায় জীবিকার একটি বাস্তব সফল রূপ দেখেছিলেন।
‘কালান্তরে’ লিখেছেন — “জীবিকায় সমবায় এই কথা বলে যে সত্যকে পেলেই মানুষের দৈন্য ঘোচে, কোনো একটা বাহ্যকর্মের প্রক্রিয়ায় ঘোচে না। এই কথায় মানুষ সম্মানিত হয়েছে। এই সমবায় তত্ত্ব একটা আইডিয়া; একটা আচার নয়। এইজন্য বহু কর্মধারা এর থেকে সৃষ্টি হতে পারে। … এই পথ দিয়ে কোনো একটি বিশেষ আকারের অন্ন নয়, স্বয়ং অন্নপূর্ণা আসবেন, তাঁর মধ্যে অন্নের সকল প্রকার রূপ এক সত্যে মিলেছে।”
এই যে জোটবদ্ধতার কথা উনি বলেছেন সেই কারণে একটি কৃষি সভায় মুসলিমদের আলাদা অবস্থানের প্রতিবাদ জানিয়ে একসঙ্গে বসতে বলেন। জমিদারি কর সংক্রান্ত পূণ্যাহ সভায় এই ঘটনাটি ঘটে। অর্থাৎ গ্রামের মানুষের মধ্যে জাতিভেদ কুসংস্কারকে ঘুচিয়ে দিতে চেয়েছিলেন যা জমিদারি ব্যবস্থার সংকল্পের কথায় উল্লেখ করা হয়েছিল। জমিদারি প্রথায় জমিদার ও প্রজার সম্পর্কটি পিতা পুত্রের মতো হবে এই বিশ্বাস তিনি করতেন। জমিজমা সংক্রান্ত নানা সমস্যা সমাধানের জন্য গ্রামের মধ্যে মন্ডলীপ্রথা চালু করেন। ১৮৬৩ সালে ‘গ্রামবার্তা প্রবেশিকা’ নামে মাসিকপত্র ঠাকুরবাড়িতে আসত। যেখানে দেবেন্দ্রনাথের জমিদারি ব্যবস্থার সমালোচনা প্রকাশিত হয়। মূলত সেই কারণেই শিলাইদহের দায়িত্ব পড়ে রবীন্দ্রনাথের উপর। জমিদারি ব্যবস্থা পালন করতে গিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক। গ্রামীন অর্থনীতিকে স্বনির্ভর করতে হলে কৃষকদের মহাজন এবং সুদখোরদের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে কৃষকদের হাতে কম সুদে ঋণ তুলে দিতে হবে। এই আশায় কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। পতিসরে প্রজাদের ঋণদারের জন্য ব্যাংক স্থাপন করে আত্মীয় বন্ধু-বান্ধবের থেকে ঋণ গ্রহণ করেন। সেই ঋণ গ্রহণের চিঠি তিনি লিখেছিলেন বন্ধু প্রিয়নাথকে। তাঁর নোবেল পুরস্কারের পঁচাত্তর হাজার টাকা তিনি আমানত রাখেন কৃষি ব্যাংকে। এই মূলধনে গ্রামের কৃষকের ঋণের চাহিদা সুলভে মেটে। মহাজন ও দেশজ জোতদারের হাত থেকে গ্রামের মানুষকে মুক্তি দেন।
তিনি চাইতেন গ্রাম গঠনে ব্যাংক স্থাপনের পাশাপাশি গ্রামের নিজের যেন পাঠশালা, ধর্মগোলা, শিল্প শিক্ষালয়, সমবেত ধান্য ভান্ডার হয়। বয়নশিল্পের উন্নতিকল্পে শ্রীরামপুর থেকে একজন ভালো তাঁতিকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে গেলেন। এতে প্রজাদের যেমন উৎসাহ বাড়ল তেমনি কর্মের সুযোগও বাড়ল। ১৯০৮ সালে কর্মীযুবক কালীমোহন ঘোষকে তিনি আহ্বান করেছিলেন গ্রামোন্নয়নের কাজে যোগ দেবার জন্য। তার আগেই যোগ দেন চন্দ্রময় সান্যাল, অতুল সেন প্রমুখ। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে এরা যুবকদের তাঁতশিল্পে যোগদানে উৎসাহিত করেন। তিনি মনে করতেন স্বদেশী দ্রব্য উৎপাদন না করতে পারলে বিদেশি দ্রব্য বর্জন সম্ভব নয়। গ্রামের মানুষের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজীর মিলের জায়গাটা হল দেশীয় প্রযুক্তি ও কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে দেশীয় শিল্পোৎপাদন আর অমিলের জায়গাটি হল রবীন্দ্রনাথ আনন্দের মধ্যে দিয়ে কর্মসম্পাদন এবং কাজের সুবিধার্থে উন্নত যন্ত্রের ব্যবহার। দেশীয় তাঁত ব্যাবসাকে সচল করতে বঙ্গলক্ষী, মোহিনী মিলের প্রচলন শুরু হয়। পাণ্টির হাটের সূচনায় তাঁর উৎসাহ, অবদান অপরিসীম। পরবর্তীকালে এই হাট ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। তিনি বলেছিলেন তিনি বলেছিলেন গ্রামই আমাদের ভারতবর্ষ। ভিক্ষাবৃত্তি অপেক্ষা গ্রামের মানুষের আত্মশক্তি প্রতিষ্ঠা, ধনের অসাম্যকে নষ্ট করতে চেয়েছিলেন। তাই জমির অধিকার কেবল প্রজাদেরই হতে পারে এটি উপলব্ধি করতেন। উচ্চশ্রেণির শোষণ গ্রামের মানুষের স্বাধীনসত্তাকে নষ্ট করে দিয়েছিল, এটার পুনরুদ্ধার করেন।
মদ গ্রহণে বিরত রাখার জন্য বিরত রাখার জন্য, কাজেকর্মে গতির জন্য তিনি গ্রামে গ্রামে কীর্তন, বাউলের আসর গড়ে তোলায় উৎসাহ দেন। জোটবদ্ধভাবে গ্রামের মানুষের কর্মের যজ্ঞকে আনন্দে পরিপূর্ণ করে তোলাই তাঁর লক্ষ্য ছিল। আর এই আনন্দের হাওয়াই ছিল তাঁর কর্মপদ্ধতির আরেক বৈশিষ্ট্য। খ্যাপা বাউলদের মন দিয়ে গান শোনা, কথা শোনা, নিরক্ষর মানুষের মধ্যে শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি গ্রামের পুরনো ঐতিহ্য যেমন — বাউল গান, লোকছড়া, মাটির পুতুল সংগ্রহে সকলকে উৎসাহিত করেছিলেন। সমস্ত কিছুতেই তিনি শিল্পের, আনন্দের, উৎসবের ছোঁয়া রাখতেন। গ্রামীন উন্নয়নের পাশাপাশি গ্রামের মানুষের মন ভালো রাখার বিষয়টিকেও খেয়াল করেন। বিভিন্ন মেলা যেমন — কাত্যায়নীর মেলা, রাজরাজেশ্বরীর মেলা চালু করেন। এই মেলায় প্রজারা যেমন নিজেদের কর্মসংস্থানের একটি সুযোগ পেয়েছিলেন তেমনই এদের প্রদত্ত কর দিয়ে জমিদার রাস্তাঘাট, জল, স্থানীয় বিদ্যালয় স্থাপন করতেন।
রোগমুক্তির জন্য প্রজাদেরকে সঙ্গে নিয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু দূরীকরণে সমবায় পদ্ধতিরই প্রয়োগ ঘটান। এলম্হার্স্টের সঙ্গে নানা পত্র আদান প্রদান করেন, পরামর্শ নেন। ইংরেজি শিক্ষক লরেন্স এর থেকে জেনে নেন রেশম শিল্পের শিক্ষা। সমবেত উপদেশ ছাড়াও তাকে আরো অনেকেই সাহায্য প্রদান করেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ব্রহ্মবান্ধব, সতীশচন্দ্র রায়, মোহিতচন্দ্র সেন, অজিতকুমার, জগদানন্দ, নন্দলাল, কালীমোহন ঘোষ প্রমুখরা।
যে আনন্দপূর্ণ পরিবেশের কথা রবীন্দ্রনাথ কর্মোন্নয়ন এবং প্রগতির জন্য উপযুক্ত মনে করতেন তাকে সমর্থন করেন পরবর্তীতে অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন। ‘Tagore and the World’ নামে প্রবন্ধটি তার প্রমাণ। মানুষের মধ্যে যে ভোগবাদী মানসিকতা রয়েছে তাকে তিনি পিছনে ঠেলতে চান প্রকৃতির সংরক্ষণ, বৃক্ষরোপণ ও বর্ষামঙ্গল দিয়ে। শিক্ষা, দারিদ্র্য দূরীকরণ, কৃষি উৎপাদন, বৃদ্ধি, ধনের সাম্যপ্রতিষ্ঠা, পল্লীশিল্প, পল্লীসংস্কৃতির সংরক্ষণে রবীন্দ্রনাথের অবদান ছিল অতুলনীয়। সেইসঙ্গে কর্মযজ্ঞে আনন্দধারা, সমবায় পদ্ধতিটি ছিল তাঁর কর্মসাধনার ঘৃতকাষ্ঠ।
তথ্যপঞ্জি
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘পল্লীপ্রকৃতি’, রবীন্দ্র রচনাবলী, খণ্ড ২৭, বিশ্বভারতী, ১৯৭৪
২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘বিশ্বভারতী’, রবীন্দ্র রচনাবলী, খণ্ড ২৭, বিশ্বভারতী, ১৯৭৪
৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’, রবীন্দ্র রচনাবলী, খণ্ড ২৭, বিশ্বভারতী, ১৯৭৪
৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’, রবীন্দ্র রচনাবলী, খণ্ড ২৭, বিশ্বভারতী, ১৯৭৪
৫. স্বপন মুখোপাধ্যায়, ‘রবীন্দ্রনাথের পল্লীভাবনা ও গ্রামীন অর্থনীতি’, পুনশ্চ, জানুয়ারি ২০১১
৬. মদনমোহন বক্সী, ‘স্বদেশ-শিক্ষা-ধর্মভাবনা রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালি, পুস্তক বিপণি, জানুয়ারি ১৯৯৭
৭. প্রশান্ত কুমার পাল, ‘রবিজীবনী, খণ্ড ৫’, আনন্দ পাবলিশার্স লিমিটেড, কলকাতা, বৈশাখ ১৩৯৭
৮. প্রশান্ত কুমার পাল, ‘রবিজীবনী, খণ্ড ১’, ভুজপত্র, কলকাতা, বৈশাখ ১৩৮৯
৯. স্বপন চক্রবর্তী, ‘গ্রন্থ, পাঠ, শিল্পকর্ম: রবীন্দ্রনাথ ও রচনার দৃশ্যপট’
১০. তপন কুমার সোম (সম্পা), রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন
১১. সজনীকান্ত দাস, ‘রবীন্দ্রনাথ জীবন ও সাহিত্য’, সুবর্ণরেখা, কলকাতা, ১৩৯৫
ঋদ্ধি পান
গবেষক, বাংলা বিভাগ
ডায়মন্ডহারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়
ফোন: 9163560166
ই-মেল: riddhipan2@gmail.com