অভিশম্পাত ও সম্পর্কের সন্ধিক্ষণ: বরাহপুরাণের শ্বাশুড়ী-বৌমা প্রসঙ্গ – সাত্বিকা চক্রবর্ত্তী
Educator Assistant, [সংস্কৃত বিভাগ,দ্বিজেন্দ্রলাল কলেজ]
সারসংক্ষেপ (Abstract in Bengali):
অষ্টাদশ মহাপুরাণের মধ্যে অন্যতম হল ‘বরাহপুরাণ’। এই বরাহপুরাণের অষ্টমাধ্যায়ের ‘ধর্ম্মব্যাধ উপাখ্যান’- এ বর্ণিত শ্বাশুড়ী-বৌমা প্রসঙ্গটি ভারতীয় পারিবারিক সম্পর্কের গভীর মনস্তাত্ত্বিক, নৈতিক ও সামাজিক বিশ্লেষণকে ধারণ করে। এখানে ধর্ম্মব্যাধ কর্তৃক প্রদত্ত ‘অভিশম্পাত’ কেবল এক অলৌকিক প্রতিক্রিয়া নয়, বরং এটি মানবসম্পর্কের অন্তর্লীন জটিলতা, অহং ও অনুশোচনার প্রতীকী প্রকাশ। এখানে শ্বাশুড়ী ও বৌমার পারস্পরিক সংঘাত নারীসত্তার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং পারিবারিক কর্তৃত্বের প্রশ্নে উদ্ভূত মানসিক টানাপোড়েনকে প্রতিফলিত করে। বরাহপুরাণ এই সম্পর্ককে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে যে, অভিশম্পাত কেবল শাস্তি নয়— এটি আত্মশুদ্ধি, নৈতিক পুনর্জাগরণ ও সম্পর্কের পুনর্নির্মাণের এক রূপক প্রক্রিয়া। এই গবেষণা সেই পৌরাণিক কাহিনিকে আধুনিক সমাজমনস্তত্ত্বের প্রেক্ষাপটে পুনরায় পাঠ করার এক প্রচেষ্টা, যেখানে পুরাণ হয়ে ওঠে মানবিক সম্পর্কের দার্শনিক প্রতিচ্ছবি।
সূচক শব্দ (KeyWords in Bengali):
অভিশম্পাত, বরাহপুরাণ, শ্বাশুড়ী-বৌমা সম্পর্ক, নারী-মনস্তত্ত্ব, ধর্মীয় ন্যায়, নৈতিক পুনর্জাগরণ, সামাজিক প্রতীকবাদ।
‘ শ্বাশুড়ী- বৌমার সম্পর্ক’ অত্যন্ত জটিল একটি বিষয় । জটিল বললাম এই কারণেই, যেহেতু খুব কম ক্ষেত্রেই আমারা এই সম্পর্কে মধুরতা ও সরলতা দেখতে পাই, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই সম্পর্ক তিক্ততা ও জটিলতায় পরিপূর্ণ । এই ‘শ্বাশুড়ী- বৌমা’ শব্দ দুটি শুনলেই আমাদের মনে যে শব্দটির সর্বপ্রথম উদয় হয় , তা হল ‘প্রতিপক্ষ’। উভয়ের মধ্যেই নিজ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার এক অদৃশ্য দ্বন্দ্ব চলতেই থাকে। এই শ্বাশুড়ী-বৌমা সম্পর্কে তিক্ততা ও জটিলতারূপ এই অযাচিত অভিশাপ কি করে ঘনিয়ে এসেছিল তা মহর্ষি ব্যাসদেব কর্তৃক ‘বরাহপুরাণ’ এর অষ্টম অধ্যায়ে ‘ধর্ম্মব্যাধ উপাখ্যান’- এ বর্ণিত হয়েছে ।
প্রাক্কালে মিথিলানগরীতে অতি ধার্মিক এক ব্যাধ বাস করতেন। তিনি ধর্মবুদ্ধিসম্পন্ন ও ধার্মিক হওয়ায় ধর্ম্মব্যাধ নামেই প্রখ্যাত ছিলেন। ‘বরাহপুরাণ’ – এর ষষ্ঠ অধ্যায় থেকে জানা যায় যে, কাশ্মীরাধিপতি বসুর দেহের রোমসমূহ থেকে পরিত্যক্ত ব্যাধই কাশ্মীরাধিপতি বসু কর্তৃক প্রদত্ত বরের প্রভাবে ‘ধর্ম্মব্যাধ’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন –
“তথা ত্বং মৎপ্রভাবেণ ধর্ম্মব্যাধো ভবিষ্যতি।।”1
এই ধর্মাত্মা ধর্ম্মব্যাধ নিজের বৃত্তি দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করে চার হাজার বছর কাটিয়েছিলেন-
“স স্ববৃত্ত্যা স্থিতঃ কালং চতুর্ব্বর্ষসহস্রকম্।”2
তবে, এখন এই বিষয়ক বিতর্কে না যাওয়াই ভালো যে, চার হাজার বছর কেও অতিক্রম করতে সক্ষম কি না কারণ মহর্ষি বাল্মীকি বিরচিত ‘রামায়ণ ‘ এর ‘আদিকাণ্ড’ থেকে আমারা জানতে পারি যে, রামের বয়স যখন প্রায় ষোল ছুঁইছুঁই তখন রাজা দশরথের বয়স ছিল ষাট হাজার বছর –
“ষষ্টিবর্ষসহস্রাণি জাতস্য মম কৌশিক।।”3
তাই এখন ধর্ম্মব্যাধের উপাখ্যানেই আসা যাক । এই ধর্মাত্মা ধর্ম্মব্যাধ প্রতিদিন নিজের কুটুম্বদের আহারের জন্য মৃগাদি বধ করতেন , আবার প্রতি পর্ব্বে স্বধর্মানুসারে পিতৃযজ্ঞ করতেন এবং অগ্নির পরিচর্যাপূর্বক অগ্নিকে তৃপ্তও করতেন। মিথ্যা কথা বলা বা কারোর প্রতি কটু বাক্য প্রয়োগ করা তার স্বভাব বিরুদ্ধ ছিল, এরূপ বলা যেতেই পারে –
“বদন্ সত্যং সুভাষিতম্।”4
ধর্মাত্মা ধর্ম্মব্যাধ এইভাবেই স্বধর্ম পালনপূর্বক জীবন নির্বাহ করতেন । এইভাবে কিছু সময় কেটে গেলে তিনি ‘অর্জ্জুনক’ নামে ধর্মবুদ্ধিসম্পন্ন এক মহাতপা পুত্রের জনক হন, তারও কিছুকাল পরে তিনি ‘অর্জ্জুনকা’ নামে এক পরমা সুন্দরী কন্যারও জনক হন। এখন পাঠকবর্গ যদি ভেবে থাকেন যে, এই অর্জ্জুনকাকে নিয়েই ঘটনাস্রোত এগিয়ে তা অভিশাপের প্রসঙ্গে গিয়ে পৌঁছবে তাহলে আমি বলবো, পাঠকবর্গ একদম সঠিক রাস্তাতেই আছেন । পিতৃতন্ত্রের মন্ত্রে দীক্ষিত অধিকাংশ বর্তমান পিতা- মাতাগণ কন্যা যৌবনের চৌকাঠ পার করলেই যে চিন্তার বশীভূত হন ‘বরাহপুরাণ’- এ মহাত্মা ধর্ম্মব্যাধও সেই একই চিন্তার বশীভূত হয়ে ভাবতে লাগলেন- “কার সঙ্গে তার কন্যার বিবাহ দেবেন , কে ই বা তার কন্যার যোগ্য পাত্র”। এই প্রসঙ্গে লেখক হুমায়ুন আজাদের একটি উক্তি মনে পড়ে যায়, তা হল-
“পিতৃতন্ত্র নারীর জন্যে যে পেশাটি রেখেছে, তা বিয়ে ও সংসার; এ-ই পিতৃতন্ত্রের নির্ধারিত নারীর নিয়তি ।”5
যাই হোক মূল ঘটনায় আসা যাক।ধর্মাত্মা ধর্ম্মব্যাধ এইরূপ চিন্তা করে স্থির করেন যে, মহর্ষি মতঙ্গের পুত্র মাতঙ্গের সঙ্গে তার কন্যা অর্জ্জুনকার বিবাহ দেবেন।অতঃপর তিনি মহর্ষি মতঙ্গের কাছে গিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করে বিবাহের প্রস্তাব রাখলেন এবং মহর্ষি মতঙ্গ মহাত্মা ধর্ম্মব্যাধকে জানালেন যে, তার পুত্র মাতঙ্গ প্রসন্নতাপূর্বক বিবাহে সম্মতি জানিয়েছেন । এখানে আমারা জানতে পারি যে, মহর্ষি মতঙ্গ পুত্রের সম্মতির উপরে নির্ভর করেই উক্ত বিবাহে সম্মতি দিয়েছিলেন কিন্তু মহাত্মা ধর্ম্মব্যাধ তার কন্যার সম্মতির অপেক্ষা করেছিলেন কি না তা জানা যায় না। এই প্রসঙ্গেও লেখক হুমায়ুন আজাদের একটি উক্তি মনে পড়ে যায়-
“বিয়ের জন্যে দরকার পুরুষ ও নারী দুজনকে; তবে বিয়েতে তাদের ভূমিকা সমান নয়; পুরুষ বিয়ে করে, নারী বিয়ে বসে, নারীকে বিয়ে দেয়া হয়, নারীর বিয়ে হয়। পুরুষ সক্রিয়, নারী অক্রিয়; তার বিয়ে হয় অন্যদের দৌত্যে, বা প্রাকৃতিক ক্রিয়াকলাপের মতো।”6
অনন্তর যথারীতি মহাত্মা ধর্ম্মব্যাধ অর্জ্জুনকাকে ধীমান মাতঙ্গের হাতে সম্প্রদান করে নিজের গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন।অপরদিকে অর্জ্জুনকা স্বামীগৃহে শ্বশুর ,শ্বাশুড়ী ও স্বামীর সেবা- শুশ্রূষা পূর্বক থাকতে লাগলেন।বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায়-
“তুমি বদ্ধ স্নেহ-প্রেম-করুণার মাঝে-
শুধু শুভকর্ম, শুধু সেবা নিশিদিন ।”7
এইভাবে সেবা-শুশ্রূষা পূর্বক দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলে একদিন অর্জ্জুনকার শ্বাশুড়ী তাকে ” তুই ব্যাধ কন্যা পতিসেবা ও তপস্যা কীরূপে করতে হয় তা কী করে জানবি” – এই বলে তীব্র ভর্ৎসনা করলেন-
“সুতা পুত্রী জীবহন্তুস্ত্বমীদৃশী।
ন জানাসি তপশ্চর্ত্তুং ভর্ত্তুরারাধনং তথা।।”8
অর্জ্জুনকা এইরূপ তিরস্কার সহ্য করতে না পেরে ক্রন্দনরতা অবস্থাতে পিতৃগৃহে গিয়ে পিতা মহাত্মা ধর্ম্মব্যাধকে সমস্ত ঘটনা জানালেন। নিজ কন্যার প্রতি এইরূপ অন্যায় এবং অমর্যাদার কথা শুনে ধর্মাত্মা ধর্ম্মব্যাধ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে মতঙ্গের গৃহের দিকে রওনা দিলেন। ধর্মাত্মা ধর্ম্মব্যাধের ক্রুদ্ধ হওয়াটা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ঘটনা, এমনটাই হওয়া উচিতও।
মহর্ষি মতঙ্গ বৈবাহিককে আসতে দেখে আসন, অর্ঘ্য ও পাদ্যাদি দান পূর্বক যথোচিত অভ্যর্থনা জানিয়ে বিনম্র বাক্যে ধর্মাত্মা ধর্ম্মব্যাধকে জিজ্ঞেস করলেন- “মহাশয়! এই শুভাগমনের অভিপ্রায় কী? কিরূপে আমি তোমার সন্তোষ বিধান করবো?”-
“কিমাগমনকৃত্যং তে কিং করোম্যাগতক্রিয়াম্ ।”9
এর প্রত্যুত্তরে ধর্মাত্মা ধর্ম্মব্যাধ বললেন- “মহাশয়! যেসকল ভোজ্য দ্রব্যের চেতনা নেই, আমি তাইই ভক্ষণ করতে ইচ্ছা করি।আপনার গৃহে সেরূপ চেতনাবর্জ্জিত খাদ্য দ্রব্য থাকে তো আমাকে প্রদান করুন, আমি আহার করবো।”
“ভোজনং কিঞ্চিদিচ্ছামি ভোক্তুং চৈতন্যবর্জ্জিতম্।
কৌতূহলেন যেনাহমাগতো ভবতো গৃহে ।।”10
মহাত্মা ধর্ম্মব্যাধের এই কথা শুনে মহর্ষি মতঙ্গ বললেন, তার গৃহে প্রচুর সুসংস্কৃত গম, ধান ও যবাদি আছে, সেগুলো মহাত্মা ধর্ম্মব্যাধ যত ইচ্ছে ভক্ষণ করতে পারেন।অতঃপর মহাত্মা ধর্ম্মব্যাধ সেই সুসংস্কৃত গম,ধান ও যবাদি দেখতে চান। মহর্ষি মতঙ্গও অনুরূপভাবে তাকে কুলা ভর্তি গম ও ধান দেখালেন । কিন্তু তা দেখা মাত্রই বিস্ময়করভাবে ধর্মাত্মা ধর্ম্মব্যাধকে আসন ছেড়ে উঠে চলে যেতে দেখে তাকে বাধা দিয়ে মহর্ষি মতঙ্গ জিজ্ঞেস করলেন-
“কিমর্থং গন্তুমারব্ধং ত্বয়া বদ মহামতে।
অভুক্তেনৈব সংসিদ্ধং মদ্গৃহে চান্নমুত্তমম্।
পাচয়িত্বা স্বয়ঞ্চৈব কস্মাত্ত্বং নাদ্য ভুঞ্জসে।।”11
[মহামতে! একি? কিজন্য তুমি প্রস্থান করছো? আমি স্বয়ং তোমার জন্য উত্তম অন্ন পাক করে রেখেছি ; তবে তা ভোজন না করেই অভুক্ত অবস্থাতেই চলে যাচ্ছ কেন?]
আমরা আগেই জেনেছি যে, মহাত্মা ধর্ম্মব্যাধ অত্যন্ত ক্রোধের সঙ্গেই মহর্ষি মতঙ্গের গৃহে এসেছিলেন এতক্ষণ তিনি মহর্ষি মতঙ্গকে কিছুই বলেননি এর কারণ হল, তিনি মহর্ষি মতঙ্গকে কিছুটা পরীক্ষাই করছিলেন বলা যেতে পারে । এরপরই তার সকল ক্রোধ আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের লাভার ন্যায় বেড়িয়ে আসতে থাকে । তিনি এবারে ঋষি মতঙ্গকে বলতে শুরু করেন । তিনি বললেন যে, ঋষি মতঙ্গ প্রত্যেকদিন হাজার হাজার কোটি কোটি জীবহত্যা করেন,তাই তার গৃহে কোনো সাধুব্যক্তিই ওই পাপান্ন ভোজনরূপে গ্রহণ করতে পারবেন না। তবে মহর্ষি মতঙ্গের গৃহে যদি কোনো চেতনাহীন এবং সুসংস্কৃত অন্ন থাকে তাহলে তা মহাত্মা ধর্ম্মব্যাধ গ্রহণ করতে রাজী আছেন, নয়তো তিনি চলে যাবেন ।
এখানেই থেমে না থেকে ধর্মাত্মা ধর্ম্মব্যাধ আরও বলেন, মহাত্মা ধর্ম্মব্যাধ প্রতিদিন গভীর অরণ্য থেকে একটি করে পশু শিকার করে এনে তা সুসংস্কৃত করে, সেই অন্ন পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার পরই তা পুত্রাদির সঙ্গে আহার করে থাকেন, কিন্তু ঋষি মতঙ্গ আহাররূপে যা গ্রহণ করেন তা নিতান্তই খাওয়ার অযোগ্য । মহাত্মা ধর্ম্মব্যাধ এখানে একটি শ্রুতির প্রসঙ্গ টেনে বলেন- ” ভগবান ব্রহ্মা আহারের জন্য ঔষধি ও বিরুধ লতা প্রভৃতি উদ্ভিদ সৃষ্টি করেছেন, সকল প্রাণিবর্গেরই সেটাই ভক্ষণ যোগ্য- এমনটাই শ্রুতিবচন। তথাপি দিব্য, ভৌম, পৈত্র, মানুষ ও ব্রাহ্ম এই পঞ্চমহাযজ্ঞ নির্দিষ্ট হয়েছে “-
“ব্রাহ্মণা তু পুরা সৃষ্টা ওষধ্যঃ সর্ব্ববীরুধঃ।
যজ্ঞার্থং তত্তু ভূতানাং ভক্ষ্যমিত্যেব বৈ শ্রুতিঃ।।
দিব্যো ভৌমস্তথা পৈত্র্যো মানুষো ব্রাহ্ম এব চ।
এতে পঞ্চ মহাযজ্ঞা ব্রহ্মণা নির্ম্মিতা পুরা।।”12
মহাত্মা ধর্ম্মব্যাধ মহর্ষি মতঙ্গকে আরও তিরস্কার করে বলেন, ভূতবর্গকে আহার দান করে এবং যথাবিধানে অতিথি সৎকারপূর্বক গৃহস্থ সাধু ব্যক্তি ও স্বজনগণ সমভিব্যাহারে আহার করলেই একমাত্র অন্ন শুদ্ধ হয় নচেৎ ওই এক একটি ধান ও যব এক একটি জীবন্ত মৃগপক্ষীতুল্য। সুতরাং দাতা ও ভোক্তার পক্ষে তা মহামাংসতুল্য। মহাত্মা ধর্ম্মব্যাধ সবশেষে তার কন্যার প্রসঙ্গ তুলে বলেন যে, তিনি তো তার কন্যাকে মহর্ষি মতঙ্গের পুত্রের হাতে সম্প্রদান করেছিলেন, কিন্তু মহর্ষি মতঙ্গের পত্নী তার কন্যা অর্জ্জুনকাকে ‘জীবঘাতীর কন্যা ‘, ‘ চণ্ডাল দুহিতা ‘ ইত্যাদি কটুবাক্যে ভর্ৎসনা করেছেন।
মহর্ষি মতঙ্গ কেমন সাধু এবং কীভাবে তিনি পিতৃযজ্ঞ সম্পন্ন করেন সেটি দেখার জন্যই মূলত মহাত্মা ধর্ম্মব্যাধ মহর্ষি মতঙ্গের গৃহে এসেছিলেন । কিন্তু সেখানে তিনি কোনো কিছুরই লেশমাত্র না দেখতে পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ে বলেন, মহর্ষি মতঙ্গের গৃহে খাদ্য গ্রহণ করা তার পক্ষে সম্ভব নয় । অতঃপর মহাত্মা ধর্ম্মব্যাধ সম্ভবত কিছুটা ব্যাঙ্গতাপূর্বকই মহর্ষি মতঙ্গকে বলেন যে, মহাত্মা ধর্ম্মব্যাধ তো জীবঘাতী কিন্তু মহর্ষি মতঙ্গ তো ধার্মিক ব্যক্তি, অহিংসাই তো তার পরম ধর্ম; আর তার পুত্র ধীমান মাতঙ্গও তো ধার্মিক ব্যক্তি তার হাতেই তো তিনি তার কন্যাকে সম্প্রদান করেছিলেন, সেই ধার্মিক পতি লাভ করে জীবঘাতক ধর্ম্মব্যাধের কন্যা অর্জ্জুনকা স্বামীর পুণ্যপ্রভাবে অবশ্যই পবিত্রতা প্রাপ্ত হয়েছে –
“মৎ সুতা জীবঘাতস্য যদোঢ়া ত্বৎ সুতেন চ।
তন্মহত্ত্বঞ্চ সম্প্রাপ্তং প্রায়শ্চিত্তং তপোধন।।”13
আলোচ্য উক্তিতে আমরা সেই চিরাচরিত প্রবাদের আভাস পাই- ‘পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য’। এরপরে মহাত্মা ধর্ম্মব্যাধ নিজের ক্রোধ সংবরণ করতে না পেরেই আসন পরিত্যাগ করে মতঙ্গের পত্নী অর্থাৎ অর্জ্জুনকার শ্বাশুড়ীকে অভিশাপ দিয়ে বললেন-
“মা স্নুষাভিঃ সমং শ্বশ্রা বিশ্বাসো ভবতু ক্বচিৎ।।
মা চ স্নুষা কদাচিৎ স্যাদ্বা শ্বশ্রূং জীবিতোমিষেৎ।”14
অর্থাৎ,” আজ থেকে শ্বাশুড়ী ও পুত্রবধূ পরস্পরকে বিশ্বাস করবে না, পরস্পরের মঙ্গল কামনা করবে না এবং তাদের মধ্যে প্রীতিভাব থাকবে না।”
এইরূপ অভিশাপ বাণী নিক্ষেপ করে তিনি মহর্ষি মতঙ্গের গৃহ পরিত্যাগ করে নিজের গৃহের উদ্দেশ্যে প্রস্থান করলেন
আমরা প্রথমের দিকেই জানতে পারি যে, করোর প্রতি কটুবাক্য প্রয়োগ করা মহাত্মা ধর্ম্মব্যাধের স্বভাব বিরুদ্ধ কাজ। কিন্তু নিজ কন্যা অর্জ্জুনকার প্রতি করা নীচ ব্যবহার তিনি সহ্য করতে না পেরে ক্রোধের বশবর্তী হয়ে এতগুলো কথা মহর্ষি মতঙ্গকে বলেছিলেন এবং অর্জ্জুনকার শ্বাশুড়ীকে অভিশম্পাত করেছিলেন । ক্রোধ হল মানুষের মধ্যে থাকা সেই শত্রু যা মানুষকে নিজ স্বভাবের বিরুদ্ধেও চালিত করে । ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’ – তে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-
“কাম এষ ক্রোধ এষ রজোগুণসমুদ্ভবঃ।
মহাশনো মহাপাপ্মা বিদ্ধ্যেনমিহ বৈরিণম্।।”15
ভারতীয় পুরাণসাহিত্যে ‘অভিশম্পাত’ কেবলমাত্র অলৌকিক শাস্তি নয়, বরং এটি মানবসম্পর্ক, নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধের প্রতীকী রূপও বটে। বরাহপুরাণে উল্লিখিত ‘শ্বাশুড়ী-বৌমা প্রসঙ্গ’ সেই দৃষ্টান্তগুলির মধ্যে অন্যতম, যেখানে অভিশম্পাতের মাধ্যমে নারী-সম্পর্কের এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক ও নৈতিক বিশ্লেষণ প্রতিফলিত হয়েছে। বরাহপুরাণ এই ঘটনাকে ব্যবহার করেছে মানবজীবনের নৈতিক ভারসাম্যের প্রতীক হিসেবে। নারী সম্পর্কের ভেতরকার টানাপোড়েনের এই উপাখ্যান পুরাণসাহিত্যের সামাজিক বাস্তবতা ও মনস্তাত্ত্বিক গভীরতার দিকটি উন্মোচিত করে। অভিশম্পাতের ফলে সম্পর্কের ক্ষয় যেমন ঘটে, তেমনি অনুশোচনা ও পুনর্মিলনের পথও উন্মুক্ত হয়— যা ‘সম্পর্কের সন্ধিক্ষণ’-এর মূল সারবস্তু।
এই উপাখ্যানটি থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, এই অভিশাপ বৃত্তান্তটির অনেক আগে থেকেই এই শ্বাশুড়ী -বৌমা সম্পর্কে তিক্ততা বিদ্যমান ছিল , এই অভিশাপ বৃত্তান্তটি ছিল কিছুটা সরকারি সিলমোহর বসানোর মতো । আজ আমরা একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই তিক্ত ও জটিলতাপূর্ণ সম্পর্কটিকে মধুর ও সরল করতে অসমর্থ ।
তথ্যসূত্র:
- বরাহপুরাণ, ৬/৩৮
- বরাহপুরাণ, ৮/১
- রামায়ণ,১/২০/১০
- বরাহপুরাণ, ৮/৪
- নারী- হুমায়ুন আজাদ
- ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থ
- বরাহপুরাণ,৮/১৩
- বরাহপুরাণ,৮/১৯
- বরাহপুরাণ, ৮/২০
- বরাহপুরাণ,৮/২৫
- বরাহপুরাণ, ৮/৩০,৩১
- বরাহপুরাণ, ৮/৩৮
- বরাহপুরাণ,৮/৩৯,৪০
- শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা,৩/৩৭
সহায়কগ্রন্থসূচী:
- Shastri, H.(1982).The Vārāha Purāņa.Varanasi:Chaukhamba Amarabharati Prakashan.
- Shastri, J, l. Bhatt, G.P. Venkatasubramania Iyer, S.(1960).The Varaha Purana(Part 1). Delhi:Motilal Banarsidass.
- Kulkarni, D, J.(2021).Shree Varaha Purana. Pune: Uma Publication.
- ঠাকুর,র.(২০১৮).সঞ্চয়িতা.কলকাতা:শুভম্.
- আজাদ,হু.(২০১৭).নারী.ঢাকা:আগামী প্রকাশনী.
- গোস্বামী,না.(১৩৭০).বাল্মীকি-রামায়ণম্.কলিকাতা:শ্রীসীতারাম বৈদিক মহাবিদ্যালয়.
- Tripathi, K,M.(1980).Ashtadash Puran Parichay.Varanasi:Chaukhamba Saraswati Bhavan.
- দাস,রা.(২০১৬). শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা.গোরক্ষপুর:গীতাপ্রেস