July 1, 2020

রাঢ়ের সম্পদ ঝুমুর তুষু ভাদু গান

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

ড. সোমা দাস মণ্ডল

রাঢ়বাংলা বাংলার সর্বত্র গানে উৎসবে ভরপুর থাকে বছরের অনেকটা সময়।  বাংলা লোকগানই তার প্রধান সম্পদ। সেখানে ঝুমুর, ভাদু,  তুষুর সুরে বেশ মিল। গানে সারল্য, উৎসবে, পার্বনে  বাংলা গানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে রাঢ় বাংলা। 

ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ঝাড়খণ্ডের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিই মূলত রাঢ় অঞ্চল। বাংলার অন্তর্ভুক্ত রাঢ় অঞ্চলের জেলাগুলি হল পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান, বীরভূম জেলার রুক্ষ্ম কাকুরে পাথুরে মাটি। এই অংশকেই রাঢ়বাংলা বলা হয়। এই অঞ্চলে যেসব লোকসঙ্গীত প্রচলিত তা হল ঝুমুর গান, টুসু, ভাদু, হাপু, ছৌ ইত্যাদি। বাংলার এইসব গান খুব জনপ্রিয়। রাঢ় অঞ্চলের সর্বত্রই কম বেশি বাউল ও ফকিরী গানের প্রচলন থাকলেও বীরভূম জেলায় বাউল গানের আধিক্য লক্ষ্যনীয়। পুরুলিয়া জেলায় অযোধ্যা, বাগমুণ্ডি ও সংলগ্ন অঞ্চলে ছৌ নাচ ও গানের আধিক্য লক্ষ্যনীয়। রাঢ়ের অন্যান্য জেলাগুলিতে ছৌ এর প্রচলন নেই। তবে সর্বত্রই ঝুমুর গানের প্রচলন রয়েছে।  সাধারণভাবে ঝুমুর গান কে লাল মাটির গানও বলা হয়। রাঢ় বাংলার মাটি কাঁকুরে লাল বা হলুদ রঙের। 

ঝুমুর গান প্রেমের গান হিসাবেই পরিচিত। যদিও কিছু গান আছে যেখানে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, দুঃখ-যন্ত্রণার কথা, আনন্দের কথা সবই এই সব গান শোনা যায়। রাঢ়ের টুসু গান মূলত ফসল ফলানোর, ফসল তোলার উৎসবের গান।  ভাদু গানও তাই। টুসু গান হয় পৌষ মাসে। ভাদু ভাদ্র মাসে। সারা মাস জুড়ে। রাঢ় অঞ্চলে  মূলত ভাদ্র ও পৌষ মাসে উৎসবের ঘনঘটা লক্ষ্য করা যায়। তাতে সব ধরনের মানুষই কমবেশি অংশগ্রহণ করে থাকে। যদিও ভাদু এবং টুসু গান মূলত মেয়েদেরই প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে হয়ে থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও উৎসবের আমেজ তৈরি হয় রাঢ় বাংলার সর্বত্র। তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে এখানকার সব ধরনের মানুষেরা।  ঝুমুর, ভাদু, টুসু গান এই অঞ্চলকে অনেক বেশি করে মাতিয়ে রাখে। পুরুলিয়া জেলার অনেক জায়গায় ছৌ নাচের প্রচলন রয়েছে। হাপু, কাঠি নাচের গান এসব এখন প্রায় শোনা যায় না। কিন্তু একসময় হাপু গানের প্রচলন ছিল অনেক বেশি। কিন্তু বাংলার সর্বত্র বিভিন্ন উৎসবে নানা ধরনের গান হয়। সেগুলির অনেক মিল ও অমিল রয়েছে। যাই হোক আমি আমার এই গ্রন্থে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং হুগলির বিভিন্ন অঞ্চলের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের কে ঘিরে মানুষের মধ্যে উন্মাদনা, কুমারী মেয়েদের যে আশা আকাঙ্ক্ষার কথা ধ্বনিত হয়ে থাকে, টুসু, ভাদু ও ঝুমুর গানে যে সাধারণ লৌকিক প্রেম প্রীতি ও আনন্দের সুর জেগে ওঠে।  

পুরুলিয়ার স্বল্প প্রচলিত লোকগান

পুরুলিয়া জেলায় যেসব লোকসংগীত অধিক প্রচলিত তার মধ্যে ঝুমুর গানই প্রধান। অন্য সব গানেও ঝুমুর গানের প্রভাব রয়েছে। সুরে ও কথায় ঝুমুরেরই প্রতিধ্বনি শোনা যায়।  এই অঞ্চলে আর যে সব গান প্রচলিত রয়েছে সেগুলি হল ভাদু, টুসু বা তুষু গান। ভাদ্র মাসের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত এখানকার মানুষেরা ভাদু পরবে মেতে ওঠে। ভাদু কন্যারূপিনী। রাজকন্যা ভদ্রেশ্বরী। তারই গুন কীর্তন। পুরুলিয়া জেলার ঘরে ঘরে গান ও উৎসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত ভাবে জড়িয়ে পড়ে  সাধারণ সব মানুষ। সারা মাস ধরে অজস্র গানে নাচে মেতে ওঠে। একইভাবে পৌষ মাসের সংক্রান্তি থেকে শুরু করে পৌষ মাসের শেষ দিন পর্যন্ত চলে টুসুর উৎসব, তুষুর গানের উৎসব। ভাদু এবং তুষু এই দুটি উৎসবে উৎসবে মেয়েরাই ব্রত উজ্জাপন করে। তারাই এই উৎসবের গান গেয়ে থাকে। নিয়ম ও রীতি নীতি অনুসরণ করে এই উৎসব কে এগিয়ে নিয়ে যায়।  এ সম্পর্কে আমি আমার এই গ্রন্থে যতদূর সম্ভব আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। পুরুলিয়া জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রচুর সংখ্যক তথ্য সংগ্রহ করেছি। বিভিন্ন লোকসংস্কৃতি বিয়ের সঙ্গে কথা বলে তাদের মত সংগ্রহ করেছি। তাদের অভিজ্ঞতা আছে আমি এই গ্রন্থে সংযুক্ত করার চেষ্টা করেছি।  পুরুলিয়া জেলার বৃত্তান্ত, পুরুলিয়া জেলার সাংস্কৃতিক মান অত্যন্ত উন্নত বহুকাল ধরেই। সে সম্পর্কে কারো কোন কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।  পুরুলিয়া জেলার সংস্কৃতিকে আমি আলাদাভাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি। এই জেলায় ঝুমুর ছাড়াও আরো যে সব গান ও উৎসব প্রচলিত রয়েছে সেগুলোও খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি নৃত্য কেন্দ্রিক যে সাংস্কৃতিক ধারা তাকে ছৌ বলা হয়। আসলে এটি নৃত্যাভিনয়। তার মধ্যে গানও গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা নিয়ে আছে। কিন্তু সেখানে নৃত্যে বীর রসের প্রাধান্য সর্বাধিক। এই উৎসব ক্রমশ পুরুলিয়া জেলার বাইরেও অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়েছে। বিদেশের অনেক জায়গাতেই ছড়িয়ে পড়েছে পুরুলিয়ার ছৌ নাচ।

পুরুলিয়া জেলায় যেসব লোকসংগীত উৎসব প্রচলিত রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম করম উতসব। ঝাড়খণ্ড ও বিহার সংলগ্ন অঞ্চলের মানুষেরা অনেকেই অনেকে করম উৎসবে মেতে ওঠেন।  যখন বাঙলা ভাষা ভাষী মানুষেরা এখানে ভাদু উৎসবে মেতে ওঠে তখন হিন্দি ভাষাভাষী অনেকেই করম উৎসব রচনা করেন।

রাঢ়ের আঙিনায় লোকগান

রাঢ় অঞ্চলের মাটি অনুর্বর, রূঢ় বা কঠোর। এই ধরনের কোন শব্দ থেকেই প্রচলিত হয়ে থাকতে পারে রাঢ় শব্দটি। সাধারণভাবে রাঢ় অঞ্চল বলতে বাংলা বিহার ও ঝাড়খন্ডের সীমান্তবর্তী অঞ্চলকে বোঝানো হয়। এখানকার মাটি অত্যন্ত রুক্ষ্ম। বর্ষার বৃষ্টির জলকে ধরে রাখার জন্য সেরকম ব্যবস্থা আগে একদমই ছিলনা। যেখানে সব নদী-নালার জল বর্ষার পরেই শুকিয়ে যায়। যেখানে রুক্ষ্ম প্রকৃতি। বিভিন্ন জায়গায় শাল, মহুয়া, সেগুন ও অন্যান্য গাছের জঙ্গলে জীব জন্তু ও মানুষের সহাবস্থান দীর্ঘদিনের। যেখানে পাথর, টিলা বিভিন্ন জায়গায় মাথা উঁচু করে আছে। সেই সব অঞ্চলে এক সময় মানুষ শিকার এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। ফলমূল সংগ্রহ করে জীবন যাপন করত। ক্রমে সেই পাথরের মাটিকে উর্বর করে তুলেছে মানবিক প্রচেষ্টা।  অনেক কাল ধরে একটু একটু করে সেখানে জনবসতি গড়ে উঠেছে। রাস্তা ঘাট হয়েছে। বাঁধ দিয়ে ধরে রাখা হয়েছে জল। এই অঞ্চলের মানুষদের জীবনযাত্রার সঙ্গে তাদের সংস্কৃতির বেশ মিল রয়েছে।  রাঢ় সংস্কৃতির অজস্র উপকরণগুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হলো এখানকার লোকগীতি। আর বিভিন্ন ধরনের লোকগীতির মধ্যে ভাদু টুসু এবং ঝুমুর গান সর্বাধিক জনপ্রিয়। যেখানে ভাদ্র মাসে সারা মাস জুড়ে ভাদু গান গাওয়া হয়ে থাকে। অনেকে ভাদু নাচ ও গানের দল গঠন করে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে গান গেয়ে থাকে। এছাড়া প্রায় সব বাড়ির মেয়েরা তাদের নিজেদের মতো করে নিজেরা গান রচনা করে এবং ভাদু দেবীকে কেন্দ্র করে সেই সব গান গুলি তারা প্রতিদিন গেয়ে থাকে। নানা ধরনের নিয়ম ও আচরণ পালনের মধ্য দিয়ে তাদের পুজোর মন্ত্রের পরিবর্তে সেই গানগুলো গেয়ে থাকে। সেই সব গানে দেবী মাহাত্য বর্ণনা হয়। দেবীই কন্য, দেবীই মা। এই গানেই থাকে তাদের আশা আকাংখ্যার নানা কথা। 

অগ্রাহায়ণের সংক্রান্তির দিন থেকে সারা পৌষ মাস জুড়ে তুষু পুজো করা হয়। পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত ভাদু গানের মতোই অজস্র গান রচনা ও গীত হতে থাকে। সে এক দারুণ আনন্দের ব্যাপার। সক্কলেই একমাস ধরে প্রতি দিনই মেতে থাকে উৎসবের আনন্দে। 

ভাদু, টুসু ছাড়াও ঝুমুর গান এই জেলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। ঝুমুর গান কে বলে যায় লাল মাটির গান। এখানের মানুষের জীবন যাপনে সারল্য যথেষ্ট। তারা একসঙ্গে থাকতে এবং একসঙ্গে কাজ করতে ভালোবাসে। এই গানগুলি তারই নিদর্শন। এখানকার লোক উতসবের গানে দেবতার প্রসঙ্গ থাকলেও সেখানে মানুষই প্রধান। দেবদেবীর কথা থাকলেও সেইসব দেবদেবী্রা মানুষের জায়গায় হাজির হয়েছে।  রাধা কৃষ্ণ শিব দুর্গা সবাই এই গানের মধ্যে অংশ নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তারা ক্রমে সাধারণ মানুষের মতোই হয়ে উঠেছে। এই সব দেব দেবীকে নিয়ে রঙ্গ রসিকতার ক্ষেত্রে তাদের কোন অসুবিধা হয়না। তাদেরকে কখনও কখনও রাধাকৃষ্ণ,  কখনো শিব-দুর্গা, কখনো রাম সীতা নামে  সবাই তাদের নিজেদের বাড়ির মানুষ। তাদের সন্তান, সন্ততির মতোই কার্তিক-গণেশ, লক্ষ্মী-সরস্বতী। সহজ সরল জীবন, তার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সারল্যই এই গানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। গানের বাণীর পাশাপাশি গানের সুরগুলিও সেভাবেই রচিত। এই অঞ্চলের গানের কথায় রাধা কৃষ্ণের প্রেম লীলা লোকসুরের সঙ্গে কীর্তনের সুরে মিলে যায়। বাংলায় বাউল গানের বিচরণ সর্বত্র। তাই পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার কোন কোন গানের সুরে বাউল গানের প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও আরো অনেক ধারায় প্রবাহিত হয়েছে রাঢ় বাংলার লোকগান।