May 1, 2025

রবীন্দ্রনৃত্যনাট্যের নায়িকাচিত্রণে নাট্যশাস্ত্রদর্শিত অষ্টনায়িকার বিন্যাস – ডঃ অরিজিৎ গুপ্ত

LOKOGANDHAR ISSN : 2582-2705
Indigenous Art & Culture

সহকারী অধ্যাপক
সংস্কৃত বিভাগ
দ্বিজেন্দ্রলাল কলেজ

“তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা,
মম শূন্যগগনবিহারী।
আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা-
তুমি আমারি, তুমি আমারি,
মম অসীমগগনবিহারী”
রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন নৃত্যনাট্যগুলিতে বিভিন্ন অবস্থা এবং বিভিন্ন প্রসঙ্গে আমরা বিভিন্ন মুখ্য নারী চরিত্র অর্থাৎ নায়িকাদের বর্ণনা পাই। ভারতীয় কাব্যশাস্ত্রে নায়িকার যে বৈশিষ্ট্যগুলি আলঙ্কারিককর্তৃক নির্দিষ্ট হয়েছে, সেগুলি যেন কবিহৃদয়ের অন্তস্থলেই লুক্কায়িত ছিল, যা্র সাথে তিনি তাঁর কল্পনাকল্পিকার স্পর্শে সৃষ্টি করে গেছেন সমগ্র গীতবিতানের শতাধিক গান। প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে প্রাণসত্তার আরোপই কবিহৃদয়ের একান্ত মেধার ফসল। তাঁর নৃত্যনাট্যের নায়িকারা তাই বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মনঃস্থিতির প্রকাশ করেছে।
সংস্কৃত সাহিত্যশাস্ত্রের ইতিহাসে পথিকৃৎ রূপে ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্র গ্রন্থে কাব্যের বিভিন্ন নায়িকার বৈশিষ্ট্য ভেদ এবং রূপায়ণ বিস্তারিত ভাবে চিত্রিত হয়েছে। নৃত্যনাট্যগুলির প্রত্যেকটি সাধারণতঃ নায়িকাপ্রধান। চরিত্র আর ঘটনার প্রয়োজনে যথাযথ পুরুষচরিত্রের সংযোজন ঘটেছে। প্রসিদ্ধ ও কল্পিত উভয়বিধ নায়িকাচরিত্র চিত্রিত হয়েছে নৃত্যনাট্যগুলিতে। যদিও, বিভিন্ন নায়িকাদের মধ্যে মুখ্য বৈলক্ষণ্য বিদ্যমান, তবু, নানা অবস্থায় গুণমুগ্ধ নায়িকার হাবভাব এবং ক্রিয়াকলাপ রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন নৃত্যনাট্যগুলিতে অবারিত ভাবে চিত্রিত করে গেছেন গীতিময়তায়। বাণীপ্রধান রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিভিন্ন গানগুলিতে বহু অমূর্ত চরিত্র চেতনসত্তার আরোপে প্রাণশীল হয়ে উঠেছে, যাদের মধ্য দিয়েই যেন নায়িকারা স্বগৌরবে সমুজ্জ্বল হয়েছে কবিপ্রতিভায়।

অষ্টনায়িকার শ্রেণীবিভাগ
সাধারণী নায়িকারা স্বাবলম্বী, নৃত্য-গীতাদি কলাবিদ্যায় পারদর্শী এবং প্রণয়ের বিষয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞ হয়, এদেরকে লাভ করাও সাধারণের একপ্রকার দুঃসাধ্যই থাকে। নাট্যশাস্ত্র অনুসারে এরা আট প্রকার হয়-
১। বাসকসজ্জা, উপযুক্ত সজ্জা এবং অলঙ্কার ধারণ করে যিনি নিজের গৃহে প্রাণের মানুষের সাথে সমাগমের জন্য প্রতীক্ষারতা।
২। বিরহোৎকণ্ঠিতা, বহুকার্যে ব্যাপৃত অনুপস্থিত প্রেমিকের বিরহে কাতরা।
৩। স্বাধীনভর্তৃকা, আমোদযুক্ত যিনি দাম্ভিক বা উদ্ধতভাবে তাঁর আজ্ঞানুবর্তী প্রেমাস্পদকে সর্বদা পার্শ্বে রাখেন।
৪। কলহান্তরিতা, ঈর্ষ্যা বা বিবাদের কারণে যিনি প্রেমিকের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অসহিষ্ণুতায় দগ্ধ।
৫। খণ্ডিতা, প্রেমাস্পদ যার প্রতি বিগতস্পৃহ অথবা অন্য নারীগ্রহণের কারণে প্রেয়সীর নিকট অনাগত।
৬। বিপ্রলব্ধা, প্রেমিক যার প্রতি উদাসীন বা প্রেমিকের দ্বারা প্রবঞ্চিত।
৭। প্রোষিতভর্তৃকা, গুরুতর প্রয়োজনবশে যার দয়িত দূরগত।
৮। অভিসারিকা, যিনি প্রেমাস্পদের সঙ্গে প্রণয়প্রার্থী হয়ে সঙ্কেতকুঞ্জে গমন করেন।

রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন গানের মধ্যে এই নায়িকাদের অধিকাংশই যথাযথভাবে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। অবস্থাবিশেষে বিবিধ শ্রেণীর নায়িকার এমন প্রাণময় আর গীতিময় প্রকাশ রবীন্দ্রপ্রতিভার বহুমুখিতার অন্যতম দৃষ্টান্ত।

• বাসকসজ্জা
উপযুক্ত সুসজ্জিত বাসগৃহে সখীদের দ্বারা উপযুক্তরূপে প্রসাধিত এবং বিভূষিত হয়ে যিনি দূরাগত দয়িতের সমাগম প্রার্থনা করেন, তিনি বাসকসজ্জা। নাট্যশাস্ত্রতে-
“উচিতে বাসকে যা তু রতিসম্ভোগলালসা।
মণ্ডনং কুরুতে হৃষ্টা সা বৈ বাসকসজ্জিকা।।
এই প্রকার নায়িকার দেখা মেলে বসন্ত নাটকের বনভূমি চরিত্রের মধ্যে – বাসন্তী বনভূমি বাসকসজ্জা নায়িকার রূপধারণ করেছে। শীতের প্রকোপে পত্রমোচনের জন্য শূন্যতাপ্রাপ্ত বৃক্ষশাখাগুলি বসন্ত আসার সাথে সাথেই নবীন পাতা ফুল এবং মুকুল দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। এখানে বনলক্ষ্মী একজন বাসকসজ্জা নায়িকা যে, দয়িত বসন্তের সমাগমের জন্য পরিপূর্ণরূপে সজ্জিতা। এখানে বসন্তের কাছে বনলক্ষ্মীর আত্মনিবেদন রবীন্দ্রপ্রতিভাস্পর্শে যেন নতুন হয়ে ফুটে উঠেছে-
“আমার সকল দেব অতিথিরে, আমি বনভূমি।
আমার কুলায় ভরা রয়েছে গান সব তোমারে করেছি দান।
দেবার কাঙাল করে আমায় চরণ যখন ছুঁই।
বাকি আমি রাখব না কিছুই।
তোমার চলার পথে ছুঁয়ে দেব ভুঁই।।”
আবার, “মায়ার খেলা’ নৃত্যনাট্যে দেখা যায়, ‘প্রমদা’ তার সখীদের বলছে তাকে পুষ্পসজ্জায় সাজিয়ে দিতে। ‘প্রমদা’র বাসকসজ্জা মনোবৃত্তিই যেন প্রকাশিত হয়েছে এই অংশে-
“দে লো সখী দে, পরায়ে গলে
সাধের বকুলফুলহার।
আধফোঁটা জুঁইগুলি যতনে আনিয়ে তুলি
গাঁথি গাঁথি সাজায়ে দে মোরে
কবরী ভরিয়ে ফুলভার।।”
চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যে অর্জুনের প্রতি অনুরাগের উন্মেষণে চিত্রাঙ্গদা তার সাথে সমাগম প্রত্যাশা করে সখীদের বলে নূতন আভরণে নূতন সাজে সাজিয়ে দিতে। নারীত্বের অকস্মাৎ জাগরণে তার দেহবল্লরী তখন রমণীসুলভ সাজে সজ্জিত হতে উদ্গ্রীব। প্রেমাস্পদ অর্জুনকে লাভ করার আগ্রহে চিত্রাঙ্গদা তখন বাসকসজ্জা-
“বসন্তে হোক দৈন্যবিমোচন নবলাবণ্যধনে।
শূন্য শাখা লজ্জা ভুলে যাক পল্লব-আবরণে।
দে তোরা আমায় নূতন করে দে নূতন আভরণে।

ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী তে নায়িকা শ্রীরাধা। যদিও রাধার মধ্যে একাধারে অষ্টনায়িকার রূপ প্রতিফলিত হয়, তাহলেও কয়েকটি ক্ষেত্রে বাসকসজ্জার রূপ যেন প্রকাশিত হয়ে ওঠে। যেমন-
“সতিমির রজনী, সচকিত সজনী শূন্য নিকুঞ্জ অরণ্য।
কলয়িত মলয়ে, সুবিজন নিলতে বালা বিরহবিষণ্ণ।।
তৃষিত নয়ানে বনপথপানে নিরখে ব্যাকুল বালা-
দেখ না পাওয়ে, আঁখ ফিরাওয়ে, গাঁথে বনফুলমালা।।’’

• বিরহোৎকণ্ঠিতা
প্রিয় যখন বিবাদের কারণে বা অসন্তুষ্ট হয়ে নয়, দৈববশতঃই বহু কাজে ব্যাপৃত থাকায় আসতে সমর্থ হয় না, তখন তার অনাগমে তার চিন্তায় দুঃখপীড়িত নায়িকাই বিরহোৎকণ্ঠিতা। নাট্যশাস্ত্রে বলা হয়েছে-
“অনেককার্যব্যাসংগাদ্যস্য নাগচ্ছতি প্রিয়ঃ।
অনাগমদুঃখার্তা বিরহোৎকণ্ঠিতা তু সা।।’’
নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদায় অর্জুনসন্দর্শনে চিত্রাংগদার অবিকশিত নারীহৃদয়ে প্রেমের অঙ্কুরণ হয়। সখীদের কাছে নূতন আভরণে সজ্জিত হয়ে ব্রহ্মচারী ব্রতধারী অর্জুনের কাছে প্রেম নিবেদন করে। রূপপিপাসু অর্জুন “রমণীর মন ভোলাবার ছলাকলা” সম্পর্কে চিত্রাঙ্গদার অনভিজ্ঞতায় তাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে। মনে মনে প্রণয়ের অনুভব হলেও প্রেমের অনাগমনে দুঃখিত অপমানিত ব্যথিত চিত্রাঙ্গদা বিরহোত্কণ্ঠিত রূপে চিত্রিত হয়েছে-
“আমি এ প্রাণের রুদ্ধদ্বারে
ব্যাকুলকর হানি বারে বারে।
দেওয়া হল না যে আপনারে
এই ব্যথা মনে লাগে।
রোদন-ভরা এ বসন্ত, সখী
কখনো আসেনি বুঝি আগে।
মোর বিরহবেদনা রাঙালো কিংশুকরক্তিমরাগে।।’’

শাপমোচন কথিকায়- অসহিষ্ণুতাবশতঃ কুশ্রী অরুণেশ্বর কে পরিত্যাগ করে বনের মধ্যে নির্জন রাজগৃহে গমন করে রাজমহিষী কমলিকা। কিন্তু দিনরাত্রিযাপনের মধ্যে দিয়ে তার মনের বিরহ যেন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। কবি লিখেছেন-
“ঐ বুঝি বাঁশি বাজে, বনমাঝে কি মনোমাঝে।
বসন্তবায় বহিছে কোথায়, কোথায় ফুটেছে ফুল,
বলো গো সজনী, এ সুখরজনী কোনখানে উদিয়াছে-
বনমাঝে কি মনোমাঝে।’’
ভানুসিংহের পদাবলীর রাধার অনেক অবস্থার মধ্যে অন্যতম বিরহিণী রূপের প্রকাশ ঘটেছে খুব স্বাভাবিক ভাবেই। শ্রীকৃষ্ণের মথুরা গমনের ফলে শ্রীরাধিকার মনঃস্থিতি বর্ণনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ-
“শ্যাম রে, নিপট কঠিন মন তোর!
বিরহ সাথি করি দুঃখিনী রাধা রজনী করত হি ভোর।“
খানিকটা মনে মনে কল্পনাপ্রবণ হয়েই যেন বিশ্বকবি একজন পুরুষ চরিত্রকে এই ‘উৎকণ্ঠিত’ হিসাবে দেখাতে চেয়েছেন। ‘নৃত্যনাট্য শ্যামা’ তে দেখা যায়- কিশোর উত্তীয় রাজনর্তকী শ্যামার প্রেমে পাগলপারা, কিন্তু শ্যামা কিছুটা জাগতিক সুখভোগের স্পৃহা থেকেই উত্তীয়ের প্রতি উদাসীন। শ্যামার একজন সখী শ্যামার প্রতি উত্তীয়ের এই প্রকৃত প্রেম অনুধাবন করতে পেরে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার প্রয়াস করেছে। এখানে উত্তীয়ের বিরহোৎকণ্ঠা তাকে বিরহী হিসেবেই চিত্রিত করেছে-
“হে বিরহী, হায় চঞ্চল হিয়া তব
নীরবে জাগ একাকী শূন্য মন্দিরে,
কোন সে নিরুদ্দেশ-লাগি আছ জাগিয়া।।”

• স্বাধীনভর্তৃকা
যার গুণগরিমায় আকৃষ্ট হয়ে সুরতসুখালস প্রিয় পুরুষ যার নৈকট্য ছাড়ে না, যে আমোদযুক্তা হয়ে নারীসুলভ আচার আচরণের মাধ্যমে প্রেমাস্পদ পুরুষকে মুগ্ধ করে রাখতে সক্ষম, সে ই স্বাধীনভর্তৃকা-
“সুরতাতিরসৈর্বদ্ধো যস্যাঃ পার্শ্বগতঃ প্রিয়ঃ।
সামোদগুণসংযুক্তা ভবেত্স্বাধীনভর্তৃকা।।’’
মায়ার খেলা নৃত্যনাট্যে ‘প্রমদা’ চরিত্রের মধ্যে এই শ্রেণীর নায়িকাকে দেখতে পাই। কেবলমাত্র নিজেকে ভালবাসে এমন একজন নারী সর্বদা সখীপরিবৃতা প্রমদা। প্রমদার মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যে আত্মহারা অমর, কুমার এবং অশোক- এই তিন পুরুষের প্রণয়নিবেদন অক্লেশে অগ্রাহ্য করে। নিজের খেয়ালেই সে গেয়ে চলে-
“ওলো, রেখে দে সখি, রেখে দে, মিছে কথা ভালবাসা।
সুখের বেদনা সোহাগযাতনা বুঝিতে পারি না ভাষা…।”
এবং
“কে ডাকে আমি কভু ফিরে নাহি চাই।
কত ফুল ফুটে উঠে, কত ফুল যায় টুটে।
আমি শুধু বয়ে চলে যাই।।”
নৃত্যনাট্য শ্যামা তে প্রেমিক উত্তীয়ের প্রতি পরিণতযৌবনা রাজনর্তকী শ্যামার নিদারুণ উদাসীনতা দেখে সখী সাবধান করেছে শ্যামাকে- জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় সে অবহেলায় কাটাচ্ছে, প্রকৃত মনের মানুষ কে উপেক্ষা করলে একবার যদি সে চলে যায়, তাকে কি আর জীবনে ফিরে পাওয়া যাবে? শ্যামার রূপগুণের প্রতি উত্তীয়ের আকৃষ্ট হওয়া সেই সাথে তাকে শ্যামার অবজ্ঞা তার স্বাধীনভর্তৃকা রূপকেই যেন স্পষ্ট করেছে-
“ধরা সে যে দেয় নাই,
যারে আমি আপনারে সঁপিতে চাই।
কোথা সে যে আছে সঙ্গোপনে
প্রতিদিন শত তুচ্ছের আড়ালে।।’’
চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যের শেষ দৃশ্যে সখীদের দ্বারা সাদর সম্ভাষণে আহ্বান জানায় সখিরা। বীরাঙ্গনা রাজেন্দ্রনন্দিনী মণিপুররাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা “আপন শক্তির অভিমান ছিন্ন করে” অর্জুনের “দৃপ্ত ললাটে” “বীরের বরণমালা” পরিয়ে স্বরূপে অবতীর্ণ হলেন। সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত অর্জুন ও তাঁকে সাদরে গ্রহণ করলেন। এখানে চিত্রাঙ্গদা নিজেকে যেমন করে প্রকাশ করেছেন তা স্বাধীনভর্তৃকারই আদর্শ রূপ-
“যদি পার্শ্বে রাখো মোরে সঙ্কটে সম্পদে,
সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে সহায় হতে
পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।
আজ শুধু করি নিবেদন-
আমি চিত্রাঙ্গদা, রাজেন্দ্রনন্দিনী।’’

• কলহান্তরিতা
যে নায়িকা ক্রোধ বিরক্তি কলহ বা অন্য কোন বিরুদ্ধ কারণে প্রিয়বাদী মধুরভাষী হিতাকাঙ্ক্ষী প্রাণনাথ স্বামীকে পরিত্যাগ করে দূরে গমন করে, পরে সময়ের ব্যবধানে অনুতাপ বা গ্লানি বা ক্রোধদগ্ধতা ভোগ করে একাকিত্বের যন্ত্রণা অনুভব করে, সাহিত্যশাস্ত্রে তাকে কলহান্তরিতা বলা হয়েছে-
“ঈর্ষ্যাকলহনিষ্ক্রান্তো যস্যা নাগচ্ছতি প্রিয়ঃ।
অমর্ষবশসংতপ্তা কলহান্তরিতা ভবেত্।।’’
শাপমোচন কথিকায় দেখা যায় অভিশপ্ত কুশ্রী রাজা অরুণেশ্বরের প্রকৃত রূপ জানতে পেরে সহ্য করতে পারে না রানি কমলিকা। অকস্মাৎ তাঁকে বঞ্চক বলে পরিত্যাগ করে দূর অরণ্যে গমন করে সে। পরে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত যেতে থাকে যখন, তখন জন্মান্তরীণ চিরবিরহের সঞ্চিত অশ্রুভার বুকের মধ্যে উছলে ওঠে, অনুশোচনায় দগ্ধ হয় কমলিকা-
“সখী, আঁধারে একেলা ঘরে মন মানে না।
কিসেরই পিয়াসে কোথা যে যাবে সে, পথ জানে না।
ঝরোঝরো নীরে, নিবিড় তিমিরে, সজল সমীরে গো
যেন কার বাণী কভু কানে আনে কভু আনে না।।
অন্যত্র “মায়ার খেলা’ নৃত্যনাট্যতে প্রমদার প্রতি মোহগ্রস্ত অমর শান্তাকে অবহেলা করে, তার থেকে দূরে চলে যায়, যে শান্তা তাকে মন-প্রাণ দিয়ে প্রকৃত ভালবেসেছে। পরে একসময় সেই ভালোবাসাকে হারিয়েই যেন স্বপনচারিণী প্রেয়সীকে স্মরণ করেছে অমর। অমরের সত্তা এখানে কলহান্তরিতা নায়িকাকে প্রকট করেছে যেন-
“কে মোরে ফিরাবে অনাদরে কে মোরে ডাকিবে কাছে,
কাহার প্রেমের বেদনায় আমার মুল্য আছে-
এ নিরন্তর সংশয়ে আর পারিনে যুঝিতে।
তোমারেই শুধু পেরেছি বুঝিতে।
যে ছিল আমার স্বপনচারিণী
তারে বুঝিতে পারিনি-
দিন চলে গেছে খুঁজিতে খুঁজিতে।’’

• খণ্ডিতা
অন্য নারীর প্রতি আকর্ষণ হেতু যথোচিত বাসগৃহে যার প্রিয়জন আসে না, প্রণয় উপেক্ষা করে অন্যত্র গমন করে, সেই অনাদৃতা দুঃখার্তা নায়িকা হলেন খণ্ডিতা-
“ ব্যাসংগাদুচিতে যস্যাঃ বাসকে নাগতঃ প্রিয়ঃ।
তদনাগমনার্তা তু খণ্ডিতেত্যভিধীয়তে।। ’’
‘মায়ার খেলা’ নৃত্যনাট্যের ‘শান্তা’ ছিলেন অমরের প্রতি সমর্পিতপ্রাণা, কিন্তু আপন মানসপ্রতিমার সন্ধানে বহির্গত হয়ে অমরই যখন তাকে পরিত্যাগ করে প্রমদার রূপগরিমায় মুগ্ধ হল, তখন অবহেলিতা ‘শান্তা’র মধ্যে খণ্ডিতা নায়িকাকেই যেন আমরা দেখতে পাই-
“কেমনে সে হেসে চলে যায়
কোন পানে ফিরেও না চায়।
এত সাধ এত প্রেম করে অপমান।”
নৃত্যনাট্যের শুরুতেই আমরা অমরের ব্যবহারের জন্য শান্তার মনের ভাবটিকে স্পষ্ট দেখতে পাই-
“যদি আরো কারে ভালোবাসো, যদি আরো ফিরে নাহি আসো,
তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও,
আমি যত দুঃখ পাই গো।।”
এখানে “আরো কারে ভালোবাসো” কথাটি অন্য নারীর সঙ্গে অমরের সমাগমের ইঙ্গিত করা হয়েছে। শান্তা সানন্দে অমরের অন্য নারীর প্রতি ভালোবাসাকে স্বীকার করে নিয়ে নিজে সকল দুঃখগ্লানি অক্লেশে বরণ করে নিতে চেয়েছেন।
• বিপ্রলব্ধা
নাট্যশাস্ত্র অনুসারে, প্রিয়জন নায়িকার নিকট আসার জন্য সম্মত হয়ে তাকে স্বীকার করতে অঙ্গীকৃত হয়েও কোনো কারণে না আসলে সেই প্রবঞ্চিত নায়িকা হয় বিপ্রলব্ধা-
“তস্মাদ্ভূতাং প্রিয়ঃ প্রাপ্য দত্ত্বা সঙ্কেতমেব বা।
নাগতঃ কারণেনেহ বিপ্রলব্ধা তু সা মতা।।’’
নৃত্যনাট্য মায়ার খেলার শেষ দৃশ্যে অনেক দ্বিধা দূরত্ব কাটিয়ে শান্তা ও অমর যখন তাদের মিলনোৎসবে উৎসবমুখর, তখন ম্লান ছায়ার মতন বিষাদপ্রতিমা প্রমদা সেখানে প্রবেশ করে। তাকে দেখামাত্রই অমরের মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। যে অমরকে শান্তা মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসে, এতদিনের দূরত্ব কাটিয়ে সে শান্তার কাছাকাছি আসলেও মন থেকে সে শান্তার প্রতি নিবেদিত হতে পারেনি দেখে নিতান্ত বঞ্চিত ভাব অনুভব করে শান্তার নিজেকেই অপরাধী মনে হতে থাকে, সে গেয়ে ওঠে –
“ছিঃ ছিঃ মরি লাজে
কে সাজালো মোরে মিছে সাজে।
বিধাতার নিষ্ঠুর বিদ্রূপে নিয়ে এল চুপে চুপে
মোরে তোমাদের দুজনের মাঝে।।”
আবার, ভানুসিংহের পদাবলীতে কবি দেখিয়েছেন, শ্রীকৃষ্ণের কপট ছলের আচরণে মর্মাহত রাধার প্রেমিকাসত্তা যেন বিপ্রলব্ধা। কৃষ্ণপ্রেমে অবগাহন করে তাকে লাভ করতে না পেরে ব্যথিতহৃদয়া রাধা বলছেন কৃষ্ণের মন নির্মম আর নির্দয়, তাই কষ্টের ইতি নেই-
“মাধব, না কহ আদরবাণী, না কর প্রেমক নাম।
জানয়ি মুঝকো অবলা সরলা ছলনা না কর শ্যাম।।”

প্রোষিতভর্তৃকা
সাহিত্যদর্পণমতে যে নারীর প্রিয় গুরুতর প্রয়োজনবশে দূরদেশে গেছে, সে ই প্রোষিতভর্তৃকা। সে বেদনার্তহৃদয়ে পতিবিরহে কাতরা হয়ে বিকীর্ণ কেশে থাকে-
“গুরুকার্যান্তরবশাদ্যস্যা বিপ্রোষিতঃ প্রিয়ঃ।
সা রূঢালককেশান্তা ভবেত প্রোষিতভর্তৃকা।।’’
ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী তে শ্রীকৃষ্ণের মথুরাগমনের প্রসঙ্গে বেশ কয়েকটি গানে শ্রীরাধা চিত্রিত হয়েছেন প্রোষিতভর্তৃকা আভাসে-
“সখি লো, সখি লো, নিকরুণ মাধব মথুরাপুর যব যায়
করল বিষম পণ মানিনী রাধা রোয়বে না সো, না দিবে বাধা,
কঠিন-হিয়া সই হাসয়ি হাসয়ি শ্যামক করব বিদায়।”
কিম্বা,
“বার বার সখি বারণ করনু না যাও মথুরাধাম
বিসরি প্রেমদুখ রাজভোগ যথি করত হমারই শ্যাম।।”

• অভিসারিকা
অভিসারিকা নায়িকার লক্ষণ সাহিত্যদর্পণ এবং উজ্জ্বলনীলমণি উভয়ত্র কথিত হয়েছে। প্রণয়ের শক্তিতে বিশ্বাসী কোন নারী যদি তার প্রেমাস্পদের সন্ধানে কোন সহচরীকে প্রেরণ করে, অথবা উদ্দীপ্তমন্মথা দুঃসাহসিনী হয়ে লজ্জা পরিত্যাগ করে নিজেই অভিসারে বহির্গত হয়, তবে তাকে অভিসারিকা-শ্রেণিভুক্ত করা হয়।
“হিত্বা লজ্জাং তু যা শ্লিষ্টা মদেন মদনেন বা।
অভিসারয়তে কান্তং সা ভবেদভিসারিকা।।’’
‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’-র গানগুলির মধ্যে কয়েকটিতে অভিসারিকা রাধার চিত্রণ লক্ষ্য করা যায়। যেমন “শাঙন গগনে…” গানটিতে দেখি, শ্রীরাধার বেশভূষা শ্রীকৃষ্ণসকাশে যাওয়ার উপযুক্তভাবেই প্রস্তুত। তিনি তাঁর সখীকে অনুরোধ করেছেন, তাঁর অবিন্যস্ত কবরীতে চম্পকফুল দিয়ে এবং কণ্ঠে মুক্তামালা দিয়ে সাজিয়ে দিতে।
“মোতিম হারে বেশ বনা দে, সীঁথি লগা দে ভালে।
উরহি বিলুণ্ঠিত লোল চিকুর মম বাঁধহ চম্পকমালে।।”
এই পরিচ্ছদ এবং অলঙ্কার ব্যতীত, এখানে সম্ভোগশৃঙ্গার বৃদ্ধি করতে ‘শ্রীরাধা’ বা ‘শ্রীকৃষ্ণ’ আলম্বন বিভাব হিসেবে এবং বিদ্যুতের চমকানি, যমুনানদীর গর্জন আর বর্ষাকালীন প্রভঞ্জন উদ্দীপন বিভাব হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে-
“উন্মদ পবনে যমুনা তর্জিত ঘন ঘন গর্জিত মেহ
দমকত বিদ্যুত পথতরু লুণ্ঠিত থরহর কম্পিত দেহ।
কাব্যশাস্ত্রসম্মত বিভাব-অনুভাবের মতোই রাধার ব্যভিচারিভাবের লক্ষণ ফুটে উঠেছে ‘কম্পিত দেহ’ এবং ‘বহু ডর’ এই দুটি অবস্থার মধ্যে দিয়ে।

মূল্যায়ন
নৃত্যনাট্য ‘শ্যামা’ এবং ‘মায়ার খেলা’ তে, শ্যামা এবং প্রমদা উভয়ই তাঁদের জাগতিক সুখ এবং সম্পত্তির বিষয়ে অত্যন্ত আত্মাভিমানী। অভীষ্ট ব্যক্তি, বিষয় বা বস্তু তাঁদের নিকটে উপস্থিত হওয়া সত্ত্বেও অতি অহংকারের বশবর্তী হয়ে তাঁরা সেগুলিকে উপেক্ষা করেন। এই ধরণের অনাদর কে সাহিত্যদর্পণে ‘বিব্বোক’ বলা হয়েছে-
“বিব্বোকস্ত্বতিগর্বেণ বস্তুনীষ্টেsপ্যনাদরঃ।”
শ্যামা ও প্রমদার সখীকণ্ঠে একটি গানই দুটি নৃত্যনাট্যে ব্যবহৃত হয়েছে নায়িকাদের উদ্দেশ্যে সাবধানবাণী হিসেবে-
“জীবনে পরম লগন কোরো না হেলা,
হে গরবিনী।
বৃথায় কাটিবে বেলা সাঙ্গ হবে যে খেলা
সুধার হাটে ফুরাবে বিকিকিনি,
হে গরবিনী।।”
এখানে, ‘সুধার হাট’ বলতে যৌবনকে বোঝানো হয়েছে, যেটি চিরস্থায়ী নয়। সখী প্রমদা বা শ্যামা কে অভীষ্ট হিতকর বিষয়ের প্রতি অবহেলা করতে নিষেধ করছে।
একজন নায়িকা তাঁর প্রেমিকের সঙ্গে উৎসাহ এবং আনন্দসহকারে ভ্রমণ করলে তাকে বলে ‘কেলি’ –
“বিহারং সহ কান্তেন ব্রীডিতং কেলিরুচ্যতে।”
সখীদের কৌশলে আহিরিণীর ছদ্মবেশে বজ্রসেনের সঙ্গে শ্যামার গোপন পলায়নের পর আমরা দুজনকে একত্রে বিহার করতে দেখি যেখানে তাঁরা তাঁদের মিলনের আনন্দ উপভোগ করছেন-
“প্রবল পবনে তরঙ্গ তুলিল, হৃদয় দুলিল,
দুলিল দুলিল।
পাগল হে নাবিক, ভোলাও দিগ্বিদিক
পাল তুলে দাও,
দাও, দাও, দাও।।”
এইভাবে, আমরা দেখতে পাচ্ছি- রবীন্দ্রনৃত্যনাট্যের নায়িকাদের গুণগত বা কার্যগত বৈশিষ্ট্যগুলির সঙ্গে সংস্কৃত কাব্যশাস্ত্রে বর্ণিত নায়িকালক্ষণের সঙ্গে একান্ত সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। নাট্যশাস্ত্রে প্রকৃত বাস্তব নায়িকাদের লক্ষণ করা হয়েছে। রবি ঠাকুরের নৃত্যনাট্যে আমরা বাস্তব কিছু চরিত্রকেই দেখতে পাচ্ছি যেগুলি কবিকল্পনার বশে অনায়াসে চিত্রিত হয়েছে। নৃত্যনাট্য ও গীতিনাট্যের ম,ধ্যে ‘বসন্ত’ তে বনলক্ষ্মী বা বনভূমি ‘মায়ার খেলা’র শান্তা-প্রমদা, ‘শ্যামা’র শ্যামা, ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’র রাধা, চিত্রাঙ্গদা’য় চিত্রাঙ্গদা, ‘শাপমোচন’-এর কমলিকা – এদের প্রত্যেকের সঙ্গেই সংস্কৃত নাট্যশাস্ত্রে বর্ণিত আট প্রকারের নায়িকার লক্ষ্মণ অনেকটাই মিলে যায়।
অতএব, রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যগুলিতে চিত্রিত নায়িকা চরিত্রগুলির বিভিন্ন অবস্থার সাথে সংস্কৃত সাহিত্যশাস্ত্রর সঙ্গে একান্ত সাদৃশ্যের পরিলক্ষিত হয়- এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হওয়া গেল।

* সহায়কগ্রন্থসূচী:
1. বন্দ্যোপাধ্যায় সুরেশচন্দ্র ও চক্রবর্তী ছন্দা; ভরত নাট্যশাস্ত্র, নবপত্র প্রকাশন, কলিকাতা, ২০২২
2. ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ; গীতবিতান(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর), বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, চৈত্র ১৩৬৪; এপ্রিল ১৯৫৮
3. ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ; গীতবিতান, কলকাতা, সাহিত্যম্, ১ বৈশাখ, ১৪০৯)।
4. ভট্টাচার্য উপেন্দ্রনাথ; রবীন্দ্র নাট্যপরিক্রমা; ওরিয়েন্ট বুক ডিস্ট্রিবিউটারস, কলিকাতা ১২, মাঘ ১৩৬৬
5. মুখোপাধ্যায় বিমলাকান্ত ও বন্দ্যোপাধ্যায় অশোক সম্পাদিত; সাহিত্যদর্পণ (বিশ্বনাথ কবিরাজ), কলকাতা, সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, ২০০৮
6. বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রুতি; রবীন্দ্র মননে নৃত্য, কারিগর প্রকাশনী, কলকাতা, মার্চ ২০২৫
7. মৈত্র অনির্বাণ ও মণ্ডল অমিত সম্পাদিত; স্বর ও বর্ণ, দ্বিতীয় সংখ্যাঃ ক্রোড়পত্র প্রতিমা দেবী, কলিকাতা, চৈত্র ১৪৩০
8. ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ; শাপমোচন কথিকা, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলিকাতা, কার্ত্তিক ১৪০৯
9. ঘোষ শান্তিদেব; গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক ভারতীয় নৃত্য, আনন্দ পাব্লিশার্স, কলকাতা
10. মুখোপাধ্যায় হীরেন্দ্রনাথ সম্পাদিত; উজ্জ্বলনীলমণি; ভারতী প্রকাশন, কলিকাতা,
11. ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ; নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কোলকাতা, পৌষ ১৪১৮
12. ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ; শাপমোচন ; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃঃ ২০, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কার্ত্তিক ১৪০৯

**************