ঊনিশ শতকের বাংলায় ‘বাবুয়ানার’ ইতি-বৃত্তান্ত- সঞ্জয় দাস
সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, বান্দোয়ান মহাবিদ্যালয়
সারসংক্ষেপ–
ঊনিশ শতকের বাংলায় ‘বাবু’ সম্প্রদায়ের উত্থান ও পতন বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির ইতিহাসে একটি বিশেষ পর্যায়। মূলত কোলকাতা বাণিজ্য-নগরীর উত্থানের সাথে সাথে, ইংরেজ বনিক ও শাসক শ্রেণির সহযোগি হিসেবে এই শ্রেণির উত্থান ঘটে। চিরস্থায়ী ভূমি বন্দোবস্তের ফলে বাংলার পুরাতন জমিদার শ্রেণি ক্ষমতা হারায় ও নিলামে ওঠে তাদের জমিদারি। সেখানে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে তাদের সহযোগি হিসেবে ব্যবসা বাণিজ্য করে হঠাৎ ধনী হয়ে ওঠা ‘চতুর ফড়িয়া-ব্যবসায়ী’ শ্রেণি সেই নিলামে ওঠা জমিদারি কিনে নতুন জমিদার হয়ে ওঠেন। কিন্তু তারা বসবাস শুরু করেন কোলকাতায়। তারা ছিলেন তাদের জমিদারিতে অনুপস্থিত জমিদার, তাদের হয়ে জমিদারি দেখাশোনা করতেন দেওয়ান, নায়েব-গোমস্তারা।
সমসাময়িক কোলকাতার নাগরিক সমাজে সেই নয়া জমিদার-ব্যবসায়ীদের সেই অভিজাত গোষ্ঠী নিজেদের বিলাস-ব্যাসনে, আমোদ-ফুর্তিতে ইংরেজদের অনুকরণে, চাল-চলনের প্রচেষ্টায় ‘বাবু’ বলে খ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন। আধুনিক যুগে আসার অব্যবহিত পূর্বের বা বলা যেতে পারে সেই সন্ধিক্ষণের সময়টাকে বাংলায় বাবু সংস্কৃতির সময় বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। লটারিতে পাওয়া বিপুল অর্থের অধিকারীর ন্যায় খুব অল্প সময়ে ধনী হয়ে ওঠায় তাদের বাহ্যিক চাক-চিক্য প্রকাশে তাঁরা বেশি ব্যাস্ত হয়ে ওঠে ও একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন।এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দেখাদেয় চারিত্রিক অধঃপতন, আমোদ–ফুর্তি, বাইজি বাড়ি গমন, আধা সাহেবিয়ানার আচার–আচরণ, পোশাক পরিচ্ছদ ও চিত্তবৃত্তি। এই পত্রের মধ্য দিয়ে বাংলার বাবু সম্প্রদায়ের সেই বাবুয়ানার ইতি-বৃত্তান্ত সন্ধান করা হয়েছে। দেখা হয়েছে তাদের জীবন যাত্রা, বিলাসপ্রিয়তা, দান-ধ্যান প্রভৃতির মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সংস্কৃতির দিকটি, বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে তার সামাজিক প্রভাব কী ছিল বা আদৌ ছিল কিনা?
সূচক শব্দ – বাবুয়ানা, আধা সাহেবিয়ানা, বিলাসপ্রিয়তা, বাবু সংস্কৃতি, শ্বেতাঙ্গ নবাব, অনুৎপাদিত ভোগবাদ, বনেদী বাড়ি, সামন্ততান্ত্রিক ।
মূল আলোচনা–
ভারতবর্ষে ‘বহিরাগত’ কম আসেনি। শাসক হিসাবে এসেছে প্রবল পরাক্রমই দুটি ধর্ম সম্প্রদায়- ‘মুসলমান’ ও ‘খ্রিষ্টান’, যাদের প্রভাব পড়েছে আধুনিক ভারতবর্ষের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির গভীরে। আমাদের কাছে ‘পাঠান-মুঘল’, ‘নবাব-বাদশাহ’ সকলেই মুসলমান, আর পর্তুগীজ, ফরাসী, ডাচ প্রভৃতি এখানে এসে যতই উপনিবেশ তৈরি করুক; তাদের মধ্যে ‘ইংরেজরা’ ছিলেন প্রধান এবং তারা সকলেই আমাদের কাছে পরিচিত হয়েছিলেন ‘সাহেব’ হিসাবে। আমাদের আধুনিক পোশাকের ক্ষেত্রেও প্রধান প্রভাব পড়েছে তাঁদেরই। বিশেষ করে রাজ অনুষঙ্গে থাকা পুরুষেরা রাজার পোশাককে নিজেদের পোশাক রূপে গ্রহণ করেছিলেন প্রাণের তাগিদে। রাজদরবারে, কর্মক্ষেত্রে সর্বত্র তাঁদের ‘রাজ পোশাক’ পরতে হত। তাই সাবেকি সাজ ছেড়ে রাজ-পুরুষেরা ‘চোগা-চাপকান-পাগড়ি’ পরতে যেমন অভ্যস্ত হন, আবার ‘কোর্ট-প্যান্ট, শার্ট-টাই-টুপি’ পরে সাহেব সাজতেও তাঁরাই ছিলেন অগ্রণী। আবার আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত পুরুষও সহজে পাশ্চাত্য পোশাককে গ্রহণ করেছিলেন। দরবারী এই সাজই কালক্রমে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের সাজ-সজ্জার রীতিতে পরিণত হয়েছে। যদিও তার মধ্যে প্রচুর সংযোজন ও বিয়োজন হয়েছে এবং সমসাময়িক আধুনিকতায় জায়গা করে নিয়েছে।
ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনে ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া-কোম্পানির আমলে বাংলায় ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী ভূমি বন্দোবস্ত প্রবর্তন করা হয় । চিরস্থায়ী ভূমি বন্দোবস্ত প্রবর্তন করার মোটামুটি পঁচিশ বছরের মধ্যে বাংলার শতকরা প্রায় ৪৫ ভাগ জমি নিলামে ওঠে এবং তা চলে যায় নূতন জমিদারদের হাতে। সেই সময় যারা এই নিলামে ওঠা গ্রাম-বাংলার জমিদারি কিনে নিয়ে নূতন জমিদার হয়েছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন কোম্পানির সহযোগি ‘চতুর ফড়িয়া-ব্যবসায়ী’। কোম্পানির আমলে কলকাতা শহরের নব্য অভিজাত শ্রেণির প্রতিষ্ঠাতা যারা ছিলেন, নিজেদের বংশ পরিচয়ে অথবা অর্থ কৌলীন্যের বিচারে তাঁরা বেশির ভাগই ছিলেন অজ্ঞাত কুলশীল ও দরিদ্র। সেই ‘দাঁওবাজ ব্যবসায়ীরা’ লটারিতে পাওয়া বিপুল অর্থের অধিকারীর ন্যায় খুব অল্প সময়ে ধনী হয়ে ওঠায় তাদের বাহ্যিক চাকচিক্য প্রকাশে তাঁরা বেশি ব্যাস্ত হয়ে ওঠে ও একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন। তাঁরা ও তাঁদের বংশধরেরা প্রায় সকলেই ইংরেজদের অধীনে দেওয়ান, বেনিয়ান, মুনশি, খাজাঞ্চী, সরকার ইত্যাদি পদে চাকরী করেন এবং ইংরাজী শিক্ষার প্রাথমিক সুবিধার সুযোগ গ্রহণ করেন, আবার এদের অনেকেই প্রথম দিকে সাহেবদের ‘ঋণ দিয়ে কোম্পানির কাগজ ও অন্যান্য দ্রব্য কেনা-বেচা করে এবং ঠিকাদারি, ইজারাদারি ও তেজারতি ব্যবসা করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। কোম্পানির অনুগ্রহে সেই অর্থ বাংলার, বিভিন্ন গ্রামের জমিদারি ও কোলকাতায় ভূসম্পত্তি কিনে তৎকালীন সমাজে রাজা-মহারাজা অথবা ধনী জমিদার রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। সমসাময়িক কোলকাতার নাগরিক সমাজে সেই নয়া জমিদার-ব্যবসায়ীদের সেই অভিজাত গোষ্ঠী নিজেদের বিলাস-ব্যাসনে, আমোদ-ফুর্তিতে ইংরেজদের অনুকরণে, চাল চলনের প্রচেষ্টায় ‘বাবু’ বলে খ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন। আধুনিক যুগে আসার অব্যবহিত পূর্বের বা বলা যেতে পারে সেই সন্ধিক্ষণের সময়টাকে বাংলায় বাবু সংস্কৃতির সময় বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
সে এক অভূতপূর্ব সময়কাল। বিশাল ভারতবর্ষ তখন ইংরেজ রাজশক্তির প্রায় করতলগত। আরও স্পষ্ট করে বললে ভারত বিদেশি শাসকের পদানত। তারই মধ্যে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ও প্রদেশের রাজা-মহারাজা, নবাবদের মত হঠাৎ হঠাৎ এখানে ওখানে ক্ষমতাসীন হতে থাকে শ্বেতাঙ্গ রাজা, সে রাজত্বে তাঁরই সর্বেসর্বা। তারা নিজেরাই তৈরি করেন নিজেদের টাকা। শুধু ‘রাজা’ নয় অনেক শ্বেতাঙ্গ সেদিন আচারে-ব্যবহারে, বিলাস-ব্যাসনে আমাদের দেশিয় নবাবদের মতো, তাঁরা ‘শ্বেতাঙ্গ নবাব’, তাঁরা হারেম পোষেন। ভারতীয় বাঈজিরা অনেকে তাঁদের আপ্যায়নের জন্য হয়ে ওঠে রাজ নর্তকী। সেই মেলামেশার দিনগুলোতে রাজা-প্রজা, সাদা-কালো ভেদাভেদ যেন লুপ্ত হয়। ফলে ভারতীয় বহুবর্ণ সমাজে যুক্ত হল নূতন এক সম্প্রদায়- অ্যাঙ্গলো ইন্ডিয়ান।
বিদেশী সংসর্গে এদিকে ভারতীয়দের মনোরাজ্যে শুরুহয় তোলপাড়- ইংরেজি শিক্ষা, স্টিম ইঞ্জিন, কলের জাহাজ, কলের গাড়ি, টরেটক্কা-টেলিগ্রাফ, নূতন ঔষধ কুইনাইন। এই নূতন দুনিয়ায় নূতন নেশা, নূতন পেশা- সাহেব ধরা, কত ভাবেইনা তারা সেদিন ভজনা করেছেন সাহেবদের। ইংরেজি শিক্ষাই শেষ কথা নয়, কোন কোন মহলে চালু হয়েছিল ইংরেজি পোশাক, ইংরেজীকেতা। তাদের কেউ কেউ স্বপ্ন দেখেন সাহেব হওয়ার। রাম প্রসাদী সুরে তাদের গান যেন- ‘এবার মলে সাহেব হব’।
কোলকাতা একটি ঔপনিবেশিক শহর হিসাবে গড়ে উঠেছিল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অষ্টাদশ শতকে একটি কৃত্রিম নদী বন্দর স্থাপন করে কোলকাতাকে একটি শহর হিসাবে গড়ে তোলে। সেই কোলকাতা ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল। ভারতের ‘সাংস্কৃতিক রাজধানী’ হিসাবে পরিচিত এই শহর ভারতীয়-সংস্কৃতি ও দর্শনকে ইউরোপীয় ঐতিহ্যের সাথে মিশ্রিত করেছিল। ইউরোপীয় বণিকদের সঙ্গে এদেশে এসেছিলেন খ্রিষ্টান মিশনারি-বুদ্ধিজীবি শ্রেণি। মূলত তাদের মাধ্যমে ও উদ্যোগে ইউরোপীয় বুদ্ধি-বিভাষার সাথে প্রাচ্যের পরিচয় হয়, ক্রমে কোলকাতা হয়ে উঠলো আধুনিক সভ্যতা, শিক্ষা-সংস্কৃতির এক অন্যতম পীঠস্থান। অপরিসীম ঐশ্বর্য আর সীমাহীন দারিদ্র, আকাশছোঁয়া অট্টালিকা আর ধুলো মাখা ঝুঁপড়ি -এসবেরই একত্র অবস্থান কোলকাতায়। এসবেরই মাঝখানে কোলকাতা আন্তর্জাতিকতায় উদ্বুদ্ধ ও বিশ্বজনীনতার পূর্ণ শহর।
১৬৯০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে আগস্ট এক বর্ষণ মুখর দিনে জব চানক নিশ্চিত প্রত্যয়ে যে গণ্ডগ্রামকে বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্র রূপে গ্রহণ করেছিলেন, তার সাথে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার ভাবনাটাও ছিল যুক্ত। কোলকাতা স্থাপনের পর বহু ইংরেজ এদেশে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন, তাদের সংস্পর্শে এসে বিশেষভাবে বাংলার কিছু সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষ হঠাৎকরে বিত্তশালী হয়ে ওঠেন। এই হঠাৎ বিত্তশালী মানুষেরাই জন্ম দেন এক বিচিত্র সমাজের, যা বাবু সমাজ নামে পরিচিত হয়। আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, চিত্তবৃত্তি, বাক্কৌশলগত ক্ষেত্রে আধা সাহেবীআনা এদেরকে সাধারণ মানুষের সমাজে করে তুলেছিল বেশ আকর্ষণীয়।
বাংলায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন স্থাপিত হয় ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর। মূলত এর অল্প কিছু কাল পরই কোলকাতায় বাবু সমাজ পরিণত রূপলাভ করে। কিন্তু এই ‘বাবু’ আসলে কারা, কিভাবে এদের উৎপত্তি তা বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও ভাষাবিদরা নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। ভাষা তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় সংস্কৃত শব্দ ‘বপ্র’ বা ‘বপ্তা’ জাত ‘বাপা’ শব্দটি থেকেই ‘বাবু’ শব্দটির উৎপত্তি। পিতা, সন্তান, মান্য বা সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি অর্থে শব্দটির প্রয়োগ করা হয়। আবার ‘বাপু’ শব্দটি থেকেও ‘বাবু’ শব্দের সৃষ্টি। এই ‘বাবু’ মুসলিম যুগে উর্দু শব্দ ভাণ্ডারে গৃহীত হয়েছিল, শব্দটি ফার্সি মূল নয়। মৌলিক অর্থ ও সম্প্রসারিত অর্থে ‘বাবু’ শব্দের প্রয়োগ মোটেই অল্প দিনের নয়। ‘বপ্র’ থেকে ‘বাবু’ ও ইংরাজী sire থেকে sir শব্দের মৌলিক ও সম্প্রসারিত অর্থের প্রয়োগের ধারাবাহিকতার মিল আছে।
অষ্টাদশ শতকে ‘বাবু’ শব্দের প্রচলন হয় বলে যারা মনে করেন, তাদের মতে মুসলিম আমলের রাজসভা ও তৎকালীন সামাজিক পরিমণ্ডলে প্রথম বাবু শব্দটি প্রচলিত হয়। বাদশাহি বিধি সম্মত তালিকায় ‘বাবু’ নামের কোন সরকারী খেতাবের সন্ধান পাওয়া না গেলেও শব্দটি খেতাবেরই স্বরূপে ব্যবহৃত হত। কোলকাতার প্রতিষ্ঠার পর প্রথম পঞ্চাশ বছরে এখানে একচেটিয়া ভাবে প্রভুত্ব করেন এই বাবু সম্প্রদায়। আদ্যন্ত সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতি পুষ্ট, স্বার্থান্বেষী, পার্সিয়ান বা পশ্চিমি আদব কায়দায় অনুপ্রাণিত নূতন এক জমিদার বা বেনিয়ান শ্রেণির মানুষেরাই প্রকৃতিগত ভাবে এযুগের ‘বাবু’। সমকালীন সমাজে সাধারণ মানুষও ঠিকভাবে জানতেন না প্রকৃত অর্থে বাবু কারা। তারা ‘শ্রী’ বা ‘Mr.’ এর পরিবর্তে ‘বাবু’ শব্দটি ব্যবহার করতেন। অবন্তী কুমার স্যান্যাল বলেছেন, পার্শিয়ান শব্দ ‘বা’ (Father) ও ‘বু’ (Sent) -থেকে এই শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে, যারা মুঘল দরবারে বিশেষ সুগন্ধি ব্যবহার করতেন তারাই ছিলেন বাবু। আবার অনেকে মনে করেন যারা ‘বাপ্তা’ জামা পরতেন তারাই বাবু। মহেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর গ্রন্থে বলেছেন, প্রাক্ ব্রিটিশ যুগে ও তাঁর সমকালীন যুগে ‘শ্রীযুত’ বা ‘দাদা” শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে ‘বাবু’ শব্দের পরিবর্তে। সমকালীন সংবাদ পত্র থেকে জানা যায়, ব্রিটিশরা ‘বাবু’ শব্দটি ব্যবহার করতেন নিম্ন শ্রেণির মানুষ ‘নেটিভ’দের সাথে সাদা চামড়ার মানুষদের পৃথক করতে। হিন্দি অভিধানে ‘বাবু’-একটি উপাধি যা, একটি বিশেষ পদমর্যাদা বা একটি বিশেষ পদ কে বোঝাত।
ভবানী চরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘নব বাবু বিলাস’ গ্রন্থে বলেছেন অসাধারণ ভাগ্যবানদের ‘বাবু’ বলে অভিহিত করা হত। তাঁর মতে, “একটা সময় ছিল, যখন ভদ্র, বিশ্বস্ত ও দক্ষ সরকারী কর্মচারীরাই বাবু নামে পরিচিত হতেন”। সুতরাং এথেকে বলা যায়, বেনিয়ান, মুৎসুদ্দি, দেওয়ান প্রভৃতি বাঙালী ধনাঢ্যের নামের সাথে ‘বাবু’ শব্দটা জড়িত ছিল।
অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কোলকাতায় জন্ম হয় এই বাবু সংস্কৃতির। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও লেখকেরা বাবুদের যা বর্ণনা দিয়েছেন তার অনুসরণে বলা যায় যে- “মুখে, ভ্রু-পার্শ্বে, চোখের কোনে নৈশ অত্যাচারের চিহ্ন স্বরূপ কালিমারেখা; শিরে তরঙ্গায়িত বাবরি চুল, দাতে মিশি, পরিধানে কালোপেড়ে ফিন্-ফিনে ধুতি, অঙ্গে অতি উৎকৃষ্ট মসলিন, গলদেশে উত্তম রূপে চুনট্ করা উড়নি, পায়ে পুরু বগল্যাস সমন্বিত চীনে বাড়ির জুতো” এই ছিল তৎকালীন বাবুদের চিত্র। গোবিন্দরাম মিত্র ছিলেন কোলকাতা শহরের প্রথম উল্লেখযোগ্য বাবু আর ভূবনমোহন নিয়োগী ছিলেন উনবিংশ শতকের শেষ বাবু।
শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ’- গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, এই বাবুরা দিনে ঘুমাইয়া, ঘুড়ি উড়াইয়া, সেতার ও বীণা বাজাইয়া, বুলবুলির লড়াই দেখিয়া, পাঁচালী শুনিয়া, আর রাতে বারাঙ্গনাদিগের আলয়ে গীতবাদ্য ও আমোদ করিয়া কাল কাটাইতো। খড়দহের মেলা, মাহেষের স্নান যাত্রার সময় কলিকাতার বেশ্যা লইয়া নৌকাযোগে আমোদ করিত। প্রধানত জমিদার ও অভিজাত ব্যক্তিরাই বাবু সংস্কৃতির তালিকায় আসেন। জমিদারির কাজে দেওয়ানরাই ছিলেন মনিবের সর্বময় কর্তা। দেওয়ানদের অর্থের প্রাচুর্য দেখে অনুমান করা যায় যে, তারা মনিবের অমনোযোগিতার সুযোগ নিয়ে তাঁর জমিদারি থেকে অর্থ ও সম্পদের লুঠতরাজ চালাতেন। বাবুদের নিজস্ব অর্থ শেষ হয়ে গেলে তাঁরা স্ত্রীর গয়না বেঁচেও আমোদ করতেন।
সেসময় অর্থের শ্রেণিভেদে বাবুদের বিভক্ত করার রীতি চালু ছিল। ঘুড়ি, তুড়ি, দান, বুলবুলি, গান, বনভোজন প্রভৃতি নয় সুলক্ষণ যুক্ত বাবুরাই ছিলেন উচ্চবর্গীয় বাবু। এদের মধ্যে রাজা গুরুদাস, রাজা ইন্দুনাথ, তনুবাবু ও রামহরি বাবু ছিলেন অন্যতম। অর্থশালী ও বিত্তবান বাবুদের আবার মোসাহেবও থাকত। বাবুদের চলাফেরা, গতিবিধির উপর কড়া নজর রাখত এরা। বাবুরা ফার্সি বলতেন গড়গড়িয়ে, ইংরেজি বলতেন খুড়িয়ে। দিনের যেটুকু সময় এরা জেগে থাকতেন, তখন চলত নানা আমোদের খেলা। তার মধ্যে ঘুড়ি ওড়ান ও বুলবুলির লড়াই ছিল অন্যতম, আজ কোলকাতায় যেখানে ছাতু বাবুর মাঠ তখন সেখানেই চলতো বাবুদের ঘুড়ি ও বুলবুলির লড়াই।
‘বাবু’ সম্প্রদায়ের জীবন ধারণের একটি দিক ছিল দান-ধ্যান ও বিলাস প্রিয়তা। প্রজন্মগত একটা বিভেদে দেখা যায়- প্রথম প্রজন্মের বাবুরা ছিলেন অনেক বেশি আমুদে ও বিলাসী এবং অনেকাংশে সামন্ততান্ত্রিক মেজাজে পুষ্ট। সেদিক থেকে পরবর্তী প্রজন্মের বা উনিশ শতকের বাবুরা ছিলেন কিছুটা উদার প্রকৃতির। বাবুরা দানশীলতার ক্ষেত্রে বলা যায় তারা সবসময় কোন মহৎ উদ্দেশ্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দান করতেন না। অর্থ ও সম্পদের প্রাচুর্য সকলের কাছে প্রকাশ করাই ছিল এদের আসল উদ্দেশ্য। নিজেদের সম্মান ও ঐতিহ্যকে বজায় রাখার জন্য প্রতিযোগিতা করে তারা অর্থ ব্যয় করতেন। গোবিন্দরাম মিত্র দূর্গা পূজায় দূর্গা প্রতিমাকে সোনা ও রূপোর পাতা দিয়ে মুড়ে দিতেন। পূজার সময় ব্রাহ্মণ ভোজনের জন্য খরচ করতেন প্রতিদিন ত্রিশ থেকে চল্লিশ মন চাল। হাট খোলার জমিদার রামতনু দত্তের বাড়ির সমস্ত বাসন পত্র ছিল সোনা আর রূপো দিয়ে তৈরি। তাঁর বাড়ি প্রতিদিন সকালে ধোয়া হত আতর জল দিয়ে। ভূবনমোহন নিয়োগী সিগারেট ধরাতেন দশ টাকার নোট দিয়ে এবং সরস্বতী পূজার শেষ দিনে সোনাগাছির বেশ্যাদের দান করতেন এক হাজারটা বেনারসি শাড়ি।
সুবীর রায় চৌধুরী তাঁর ‘The Lost World of the Babus’ গ্রন্থে বলেছেন- বাবু সম্প্রদায়ের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল আড্ডা। প্রতিদিন বিকেল ও সন্ধ্যার সময় বাবুরা ও তাঁর সহযোগি মোসাহেবদের নিয়ে আড্ডা জমাতেন। তাদের আড্ডার অনেক বিষয়বস্তুই ছিল বাগ্মিতা। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার পাশাপাশি গুজব-রটনাও এই আড্ডায় আলোচিত হত। কখনো কখনো কোন ইংরেজ সাহেবও এই আড্ডায় যোগদান করতেন।
বাবুদের জীবনচর্যার ও প্রত্যহ কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বেশ্যা গৃহে সময় কাটান। বাবুরা সারাদিন ঘুমিয়ে বা ঘুড়ি উড়িয়ে, বুলবুলির লড়াই দেখে রাতে বাবরি করা চুলে সিঁথি কেটে, হাতে গোলাপ ফুল নিয়ে সুরার সাগরে ডুবে যাত্রা করতেন বেশ্যা বাড়ি বা উপপত্নীর নিকট। উৎসব-পার্বণ ও আমোদ-আহ্লাদের উপাদান হিসাবেও বাঈজিরা বাবুদের কাছে সমাদর পেতেন। সেই সময় তারা বাবুদের গৃহে এসে নাচ-গানের আসর জমিয়ে তুলতেন। উৎসবের শেষে অঢেল অর্থ ও সোনা-গয়না নিয়ে তারা বিদায় নিতেন।
কোলকাতা হল ‘উৎসব নগরী’। আজকের কোলকাতা যেমন উৎসবের রঙে মাতোয়ারা হয়, একইভাবে সেকালের কোলকাতাও উৎসবের রঙে রঙিন হয়ে উঠতো। আর সেই উৎসবের উদ্যোক্তা ও মধ্যমণি ছিলেন বাবুরা। সেকালের কোলকাতায় প্রধান ও শ্রেষ্ঠ উৎসবে পরিণত হয়েছিল দূর্গোৎসব। নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বাড়িতে ছিল এর উৎপত্তিস্থল। রাজা নবকৃষ্ণ দেব, দেওয়ান রামচাঁদ রায় ও বাবু আশুতোষ দেব প্রমুখের বাড়িতে দূর্গাপূজা হত রাজসূয় যজ্ঞের মত আয়োজনে। দূর্গাপূজার পাশাপাশি বাবুদের আয়োজনে কোলকাতার অপর একটি বড় উৎসব ছিল চড়ক। সবচেয়ে প্রাচীন চড়কের মেলা হত কালীঘাটে। অতিথি-অভ্যাগতদের সমাগমে অনুষ্ঠানের দিনগুলি মধ্য কোলকাতার প্রতিটি বাড়ি গমগম করত। বাবুরাও তাদের বিবিদের নিয়ে দেখতে যেতেন সঙের নাচ-গান। কোলকাতায় এই দুই উৎসবের পাশাপাশি বাবু সমাজ রামলীলা, গাজন, রথযাত্রা, রাস ও মুসলমানদের মহরম উপভোগ করতেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে সারস্বত-বাঙালী মসী চর্চায় মেতে লক্ষ্মীর কৃপা লাভে বঞ্চিত হয়েছেন বলে প্রচলিত প্রবাদ আছে। তবে একথা যে সর্বাংশে সত্য নয়, তা প্রমাণ করেছিলেন কয়েকজন বাবু পর্যায়ভুক্ত বাঙালী। ঊনবিংশ শতাব্দীর ঊষা কাল থেকে সদ্য কেরানি হিসাবে পরিচিত বাঙালীর অন্য পরিচয়ও পাওয়া যায়, যারা বিপুল উদ্যোগে এবং একনিষ্ঠ প্রয়াসে ব্যবসায়ীর পরিচয় গড়ে তুলেছিলেন। বাণিজ্যে বাঙালীর পরিচয়ের পথিকৃৎ সেই যুগের অগ্রগণ্য ছিলেন রাম দুলাল দে, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, মতিলাল শীল, দিগম্বর মিত্র প্রমুখ। পলাশীর যুদ্ধের পর লবণের ব্যবসা করে হঠাৎ বড়লোক হয়ে যাওয়া বাবুদের স্বাভাবিক জীবনের অস্বাভাবিক কাহিনী এক কথায় সত্যই চমকপ্রদ। এই সকল বাবুরা “বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী”কে শিরোধার্য করে শিল্পোদ্যোগকে সর্বাত্মক করার প্রয়োজন অনুভব করেন। তাদের ধারণা ছিল গ্রাম বাংলার অর্থনৈতিক পুনরুৎজীবনকে বাস্তব করে তুলবে নূতন শিল্পোদ্যোগই। তাই তারা চেয়েছিলেন কৃষি ও শিল্পের সার্থক সমন্বয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে হঠাৎ করেই এই সংস্কৃতি পতনের পথে চালিত হয়। এ. কে. রায় তাঁর গ্রন্থে প্রাইভেট ব্যাঙ্ক এর পতনকে বাবু সংস্কৃতির পতনের অন্যতম কারণ বলে মনে করেছেন। প্রাইভেট ব্যাঙ্ক এর পতনের ফলে বাবুদের ব্যবহারিক জীবনে অর্থের ঘাটতি ঘটে। এর ফলে তাদের আমোদ ও বিলাসপ্রিয়তায় মহাসঙ্কট দেখা যায়। আরও স্পষ্ট করে বলা যায় অনুৎপাদিত ভোগবাদ, নূতন সময় ও সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারা এবং পরিবর্তিত নূতন অর্থনীতিকে আত্মস্থ করতে না পারাই বাবু সংস্কৃতির পতনের কারণ ছিল। ভবানী চরণ বন্দ্যোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন, সমস্ত বাবুরাই যে অভিজাত পরিবার থেকে আসত তা নয়। ফাটকা কারবার, কালো বাজারী ও যুদ্ধের বাজারে ব্যবসা করে হঠাৎ প্রচুর অর্থের অধিকারী হয়েছিলেন বাবুরা, তাদের অর্থ নিঃশেষ হয়ে যেত অনিয়ন্ত্রিত ব্যয়ের ফলে বা ব্যাবসার মানের অবনতির সাথে সাথে। তাই সহজেই শেষ হয়ে যেত সেই বাবুদের আতিশয্য।
কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর ‘হুতোম পেঁচার নক্সা’ গ্রন্থে বলেছেন- বাবুদের পরিবার ধীরে ধীরে বিশাল বাঁশ ঝাড়ের মত আকার ধারণ করলে, অর্থের অভাবে জীবনযাত্রার চাকচিক্য কমতে থাকে। তাছাড়া ইংরাজী শিক্ষার প্রভাব, জোয়ারের জলের মত ভাসিয়ে দেয় অর্ধ শিক্ষিত, আধা সাহেবী বাবুদের সংস্কৃতিকে। আধুনিকতার সাথে তাল রেখে চলতে না পারা এই বাবুরা ক্রমশই হারিয়ে যেতে থাকে কালের অতলে। বাণিজ্যিক ‘বাবু’দের বাণিজ্যে অর্থের অপচয় সর্বশান্ত করে দেয় এই বাবু সংস্কৃতিকে। বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এই বাবুদের বংশ ধরেরাই সমুদ্র পাড়ি দেয় আধুনিক শিক্ষার খোজে। পরবর্তী বংশ ধরদের কৃতিত্বের আলোয় ঢেকে যায় তাদের পূর্ববর্তী পুরুষদের গ্লানি। আধুনিক ও ইংরেজি শিক্ষিত নূতন সমাজ ও সভ্যতার সাথে সামঞ্জস্য বিধান করতে না পেরে বাবু সমাজ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় ভবিষ্যতের আলোকে। নূতন ও পুরাতনের সাথে তাল মেলাতে না পেরে তাদের অস্তিত্ব হয়ে পড়ে সঙ্কটাপন্ন। একইভাবে ধীরে ধীরে নিভে যায় বাঈজী বাড়ির ঝাড়লণ্ঠন। আর কোলকাতার বনেদী বাড়ির মৃত ধ্বংসস্তূপের আড়ালে চলে যায় বাবু সম্প্রদায়ের ইতিবৃত্ত। কিছু বিদেশি ও দেশীয় সংবাদ পত্রের রিপোর্টের ভিত্তিতে বলা যায় ঊনবিংশ শতকের শেষ পাদে এই সংস্কৃতির পতন ঘটে। তবে বিংশ শতকের গোড়ার দিকেও অনেক অভিজাত ও ধনাঢ্য মানুষ এই বাবু সংস্কৃতিকে কিছুটা টিকিয়ে রেখেছিলেন মাত্র।
গ্রন্থপঞ্জী:-
১। ভবানী চরণ বন্দ্যোপাধ্যায় – নব বাবু বিলাস (১৮২৫)।
২। কালী প্রসন্ন সিংহ – হুতোম পেঁচার নকশা।
৩। শিবনাথ শাস্ত্রী – রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ।
৪। সমর সেন – বাবু বৃত্তান্ত।
৫। প্যারিচাঁদ মিত্র – আলালের ঘরের দুলাল।
৬। অর্ণব সাহা – বাবু-বিবি সম্বাদ (সপ্তর্ষি প্রকাশন)।
৭। প্রমথ নাথ বিশী – কেরি সাহেবের মুন্সী।
৮। রাজ নারায়ণ বসু – সেকাল আর একাল।
৯। রাধা প্রসাদ গুপ্ত – কলকাতার বাবু।
১০। পিনাকরুদ্র সেন – বাবু কলকাতার বিবি বিলাস।
১১। সুবীর রায় চৌধুরি- দ্যা লস্ট ওয়াল্ড অফ্ বাবুস্।
১২। কল্যানী দত্ত- থোড় বড়ি খাড়া।
Phone No-9432416655 Email. Id-sanjoydas6655@gmail.com